বাংলাদেশে পণ্য পরিবহনের জন্য প্রয়োজনীয় জাহাজের অর্ধেকও নেই। অথচ দেশের আমদানি-রপ্তানি পণ্যের ৮০ শতাংশেরও বেশি সমুদ্রপথে আসে। বাণিজ্য প্রতিবছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দরে খোলা পণ্য, জ্বালানি ও ভোজ্যতেল পরিবহন হয়েছে ১৩ কোটি টন। কনটেইনার পরিবহন হয়েছে ৩২ লাখ ৯৬ হাজার ৬৭ টিইইউ (২০ ফুট দৈর্ঘ্যের সমতুল্য ইউনিট)।
দেশে পর্যাপ্ত জাহাজ না থাকায় এসব পণ্যের ৯০ শতাংশের বেশি পরিবহন করে বিদেশি পতাকাবাহী জাহাজ। দেশের পতাকাবাহী ১০০টি জাহাজের পণ্য পরিবহন ক্ষমতা মাত্র ৫০ লাখ টন। এর মধ্যে কনটেইনারবাহী জাহাজ মাত্র আটটি। তবুও চট্টগ্রাম বন্দরে সর্বশেষ অর্থবছরে পণ্যবাহী জাহাজ এসেছে চার হাজার ৭৭টি।
জাহাজ রপ্তানির বিশ্ববাজারও ধরতে পারছে না দেশ। বৈশ্বিক বাজার প্রধানত চীন, কোরিয়া ও জাপানের দখলে। তবে ছোট ও মাঝারি জাহাজের বাজারে বাংলাদেশের বড় সম্ভাবনা আছে। ১২ হাজার ডিডব্লিউটি ক্ষমতাসম্পন্ন মাল্টিপারপাস শিপ, ফিডার ভেসেল ও ফেরির বৈশ্বিক বাজার প্রায় ১১৫ বিলিয়ন ডলার। হিসাব অনুযায়ী, ২০২৭ সালের মধ্যে যদি বাংলাদেশ এই বাজারের মাত্র ১ শতাংশ দখল করে, তবে বছরে এক বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার আয় হবে।
বর্তমানে বাংলাদেশে বছরে মাত্র ২০টি জাহাজ নির্মাণের ক্ষমতা আছে। নৌবাণিজ্য দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, দেশে যে পরিমাণ পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়, তাতে প্রায় আড়াই শতাধিক নিজস্ব জাহাজ প্রয়োজন। বর্তমানে আছে মাত্র ১০০টি। মার্চেন্ট মেরিনার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী জানান, আন্তর্জাতিক মেরিটাইম অনুযায়ী যে কোনো দেশের সমুদ্রবাণিজ্যে ৪০ শতাংশ দেশীয়, ৪০ শতাংশ বিদেশি ও বাকি ২০ শতাংশ যৌথভাবে পরিচালিত হয়। বাংলাদেশের ১০০টি দেশি জাহাজ মাত্র ১০ শতাংশ পণ্য পরিবহন করতে সক্ষম।
সম্প্রতি এক সেমিনারে শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, “বিশ্ব এখন পরিবেশবান্ধব জাহাজ চায়। যারা পরিবেশবান্ধব জাহাজ তৈরি ও রপ্তানি করবে, তারা সামুদ্রিক অর্থনীতির নেতৃত্ব দেবে। শিল্প মন্ত্রণালয় শিপইয়ার্ডগুলোর জন্য বৈশ্বিক গ্রিন সনদ, নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার ও পরিবেশবান্ধব জাহাজ তৈরিতে কাজ করবে।”
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান ড. জাইদি সাত্তার বলেন, “বিশ্বের ৮০ শতাংশ বাণিজ্য সমুদ্রপথে হয়। জাহাজের বহর বাড়লে নিজেদের আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহন করে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় ও আয় করা যায়।”
কেএসআরএম গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক মেহেরুল করিম বলেন, “দেশে পণ্য আমদানি-রপ্তানি তুলনায় জাহাজের সংখ্যা অনেক কম। বহর বাড়লে দেশি নাবিকদের কর্মসংস্থান, পণ্য পরিবহন ও বৈদেশিক মুদ্রা আয় আরও বাড়বে। আমাদের কোম্পানির পরিকল্পনা রয়েছে। বিএসসির নতুন জাহাজ কেনা খাতকে আরও সমৃদ্ধ করবে।”
বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি সচল জাহাজ আছে ১০০টি। পাইপলাইনে চারটি জাহাজ, রেজিস্ট্রি হলে সংখ্যা হবে ১০৪। বেসরকারি খাতের ৯৫টি জাহাজ, সরকারি বিএসসির পাঁচটি। বিএসসি ১৯৭২ সালে ব্যবসা শুরু করে। বেসরকারি খাত যুক্ত হয় ১৯৭৮ সালে।
চট্টগ্রাম বন্দরের গত পাঁচ অর্থবছরের তথ্য দেখায়, সমুদ্রবাণিজ্য ক্রমেই বাড়ছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দরে হ্যান্ডলিং হয়েছে ৩২ লাখ ৯৬ হাজার ৬৭ কনটেইনার টিইইউ ও ১৩ কোটি ৭ লাখ ২৪ হাজার ৭৮৩ টন কার্গো। জাহাজ এসেছে ৪ হাজার ৭৭টি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছিল ৩১ লাখ ৬৮ হাজার ৬৯০ একক, কার্গো ১২ কোটি ৩২ লাখ ৪২ হাজার ৭৪৮ টন, জাহাজ এসেছে ৩৯৭১টি। ২০২২-২৩ সালে হ্যান্ডলিং ৩০ লাখ ৭ হাজার ৩৭৫ একক, কার্গো ১১ কোটি ৮২ লাখ ৯৭ হাজার ৬৪৩ টন, জাহাজ এসেছে ৪২৫৩টি। ১৯৭৭ সালে কনটেইনার অপারেশন শুরুর পর এবার সর্বোচ্চ রেকর্ড হয়েছে।
মোট কনটেইনার বাণিজ্যের ৯৯ শতাংশ চলে চট্টগ্রাম বন্দরে। বাকি ১ শতাংশ মোংলা বন্দরে। চট্টগ্রাম বন্দরে মোট পণ্যের ২৩ শতাংশ কনটেইনার, বাকি ৭৭ শতাংশ খোলা পণ্য। চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, “নোঙর করা জাহাজের ৪৫ শতাংশ কনটেইনারবাহী, ৪৫ শতাংশ বাল্ক ক্যারিয়ার, ১০ শতাংশ তরল পণ্যবাহী। কনটেইনারে মূলধনি যন্ত্রপাতি, গাড়ি, ফলমূল ও গার্মেন্টস পণ্য পরিবহন হয়। খোলা পণ্যে আসে চাল, গম, সিমেন্ট, ক্লিংকার।”
বিএসসি ১৯৭২ সালে ‘এমভি বাংলার দূত’ দিয়ে শুরু করে। ১৯৮২ সালে বহরে ২৭টি জাহাজ, পরে ৩৮টি। বর্তমানে মাত্র পাঁচটি। নতুন জাহাজের অভাবে দুই জাহাজ বিক্রি হয়, সংখ্যা কমে ১০০। ২০১৮-১৯ সালে সংস্থাটি ৬টি নতুন জাহাজ সংগ্রহ করে, একটি দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত। চলতি বছরে নতুন দুটি জাহাজ যুক্তের পরিকল্পনা রয়েছে। সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “অদূরদর্শিতা, দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে বিএসসি পিছিয়ে পড়েছে।”
বেসরকারি খাতের প্রথম জাহাজ ‘এমভি আল সালমা’ আসে ১৯৭৮ সালে। বর্তমানে ১৬টি কোম্পানির ৯৫টি জাহাজ সচল। করোনার পরে ২০২১-২২ সালে ২৬টি নতুন জাহাজ যুক্ত হয়, পরে আবার নতুন নিবন্ধনের হার কমে।
দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা বাড়াতে সরকার করোনা পরে নীতিমালা গ্রহণ করেছিল। ৫৫০০ ডিডব্লিউটি বা ১০০ মিটার দৈর্ঘ্যের নিচে জাহাজ আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়। কাঁচামাল আমদানি ও অন্যান্য সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। এডিআর কর্মসূচি ও ঋণ সুবিধা তৈরি করা হলেও ২০২১-২২ সালের গতিসম্পন্ন বাস্তবায়ন হয়নি। সম্প্রতি ৫০০০ ডেড ওয়েট টনের সমুদ্রগামী জাহাজ আমদানিতে ৭.৫ শতাংশ ভ্যাট অব্যাহারের প্রস্তাব অনুমোদন হয়েছে। এর ফলে দেশে জাহাজ সংখ্যা আরও বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হলো।