১৯৭০-এর দশকের মুদ্রাস্ফীতি আজও অর্থনীতির ইতিহাসে সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করছে। সেই সময়ের ঘটনা কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর নীতিনির্ধারণের দিকনির্দেশনা হিসেবে রয়ে গেছে। তবে ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মুদ্রাস্ফীতি আমাদের আবার প্রশ্ন করতে বাধ্য করেছে: অতীত থেকে আমরা কী শিখছি, এবং সেই শিক্ষাগুলো বর্তমান আর্থিক বাস্তবতায় কতটা প্রযোজ্য?
অতীতের গল্প ও মুদ্রাস্ফীতির দীর্ঘস্থায়ী ছাপ
মুদ্রাস্ফীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এটি আমাদের অর্থনৈতিক কাহিনীগুলোতে দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ফেলে। অর্থনীতিবিদরা প্রায়ই ভবিষ্যতের মুদ্রাস্ফীতির প্রত্যাশা “অ্যাঙ্কর” করার গুরুত্বের কথা বলেন। কিন্তু অতীতের মূল্যস্ফীতি নিয়ে আমাদের ব্যাখ্যা প্রায়শই সমান বা আরও বেশি প্রভাব ফেলে।
১৯৭০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশে মুদ্রাস্ফীতি তীব্র হয়। এই সময়ের ব্যাখ্যা সাধারণত এভাবে বর্ণিত হয়: ১৯৬০-এর শেষের দিকে সরকারী ব্যয় অত্যধিক বৃদ্ধি পেয়েছিল, শক্তিশালী শ্রমিক ইউনিয়ন বেতন বৃদ্ধির দাবি তুলেছিল, এবং OPEC-এর তেলের দাম বৃদ্ধি পুরো পরিস্থিতিকে আরও তীব্র করেছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক রাজনৈতিক চাপের মুখে অর্থের পরিমাণ বাড়ায়।
১৯৭৯ সালে পল ভলকারের নেতৃত্বে ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার আকাশচুম্বী করে অর্থনীতিকে মন্দার দিকে ঠেলে দেয়। যদিও “ভলকার শক” মার্কিন অর্থনীতিকে গভীর মন্দার মুখে ফেলে এবং বেকারত্ব বাড়ায়, তবুও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসে। এই গল্প থেকে শিখানো হয় যে, অতিরিক্ত অর্থ সরবরাহ এবং সীমিত পণ্যের কারণে মুদ্রাস্ফীতি হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি সুদের হার বাড়াতে রাজনীতি থেকে স্বাধীন থাকে, তবে তারা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়। এই নীতি ২০শ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত প্রযোজ্য হয়েছিল।
২০২১-২৩ সালের মুদ্রাস্ফীতি: নতুন বাস্তবতা
২০২১-২৩ সালের মুদ্রাস্ফীতি প্রথাগত ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সেই সময়ের মূল্যস্ফীতি কতটা পুরোনো পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তা নিয়ে দুইটি সাম্প্রতিক বই তীব্র বিতর্ক উত্থাপন করেছে।
ব্রায়ান গ্রিফিথস তার বই Inflation Is About More Than Money-এ বলেন যে, পুরোনো নীতিমালা এখনও প্রযোজ্য। তিনি যুক্তি দেন, যদি কোভিড মহামারির পর সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেই নীতিমালা অনুসরণ করত, তবে ২০২১-২৩ সালের মুদ্রাস্ফীতি এত তীব্র হতো না।
অপর দিকে, মার্ক ব্লাইথ এবং নিকোলো ফ্রাকারোলি তাদের বই Inflation: A Guide for Users and Losers-এ বলেন, ১৯৭০ এবং ১৯৮০-এর দশকের মুদ্রাস্ফীতি পদ্ধতি অনেকক্ষেত্রে ভুল। তারা মনে করেন, বর্তমান কাঠামোর ভিত্তি এক ভুল গল্পের ওপর তৈরি। যদি আমরা মুদ্রাস্ফীতির গল্প অনুসারে নীতি নির্ধারণ করি, তবে নতুন গল্প প্রয়োজন যা সাধারণ মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত না করেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখবে।
মনেটারিজম: গ্রিফিথসের দৃষ্টিভঙ্গি
গ্রিফিথস পুরোনো মনেটারিস্টদের মত মনে করেন, মুদ্রাস্ফীতি মূলত সরকারের দ্বারা সৃষ্ট অতিরিক্ত অর্থ সরবরাহের ফল। তবে তিনি “প্রাগম্যাটিক মনেটারিজম” ধারণা তুলে ধরেছেন। এতে স্বীকার করা হয় যে, সরবরাহে প্রভাবশালী ধাক্কা সাময়িক মুদ্রাস্ফীতি ঘটাতে পারে, এবং অর্থের চাহিদা সব সময় স্থিতিশীল নয়।
২০০৮ সালের বিশ্ব আর্থিক সংকটের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদ শূন্যে নেমে আসে এবং “কোয়ান্টিটেটিভ ঈজিং” নামে অস্বাভাবিক উপায়ে সম্পদ ক্রয় শুরু করে। গ্রিফিথস মনে করেন, এই দীর্ঘমেয়াদী নীতিমালা শেষে ২০২১ সালের মুদ্রাস্ফীতি প্রমাণ করে মনেটারিজমের যুক্তি কাজ করেছে।
গ্রিফিথসের মতে, মুদ্রাস্ফীতি শুধু আর্থিক নয়, নৈতিকও। এটি জনসাধারণের সম্পদ হরণ করে, বিশ্বাস ও সামাজিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করে। তাই মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর আর্থিক ব্যথা, সুদের হার বৃদ্ধি, জনসাধারণের ব্যয় কমানো এবং বেকারত্ব মেনে নেওয়া অপরিহার্য।
তিনি উল্লেখ করেন, ২০২১-২৩ সালের সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকদের দেরি হওয়ায় মুদ্রাস্ফীতি তীব্রতর হয়। অতিরিক্ত দায়িত্ব, যেমন আর্থিক নিয়ন্ত্রণ ও জলবায়ু নীতি, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তাদের মূল কাজ থেকে বিভ্রান্ত করেছিল।
শ্রেণীসংঘাত এবং মুদ্রাস্ফীতি: ব্লাইথ ও ফ্রাকারোলির বিশ্লেষণ
ব্লাইথ ও ফ্রাকারোলি বলেন, মুদ্রাস্ফীতি সবসময় সরকারি অর্থ সরবরাহের ফলে হয় না। তারা দেখান, কোভিড তহবিল মানুষের হাতে যে পরিমাণ অর্থ পৌঁছেছে, তা সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ব্যাখ্যা করতে যথেষ্ট নয়। বরং সরবরাহ চেইনে বাধা এবং জ্বালানি-মূল্য বৃদ্ধির মতো বহিরাগত ধাক্কা বেশি ভূমিকা রেখেছে।
তাদের মতে, ২০২১-২৩ সালের মুদ্রাস্ফীতি মূলত শ্রেণীসংঘাতের অস্ত্র। উচ্চ-আয় ও কর্পোরেট ক্ষেত্রের লোকেরা লাভবান হয়, আর নিম্ন-আয়ের মানুষ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উদাহরণস্বরূপ, খাদ্য ও জ্বালানিতে মূল্য বৃদ্ধি নিম্ন-আয়ের মানুষকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে, আবার স্থির সুদের বন্ধকী থাকলে উচ্চ-আয় পরিবার কিছুটা লাভবানও হয়েছে।
মুদ্রাস্ফীতির সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব
গ্রিফিথস এবং ব্লাইথ ও ফ্রাকারোলি একমত যে, মুদ্রাস্ফীতি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাবও ফেলে। তবে তাদের মনোযোগ আলাদা। গ্রিফিথস মনে করেন, মুদ্রাস্ফীতি জনসাধারণের নৈতিক মান কমিয়ে দেয় এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা ভঙ্গ করে। ব্লাইথ ও ফ্রাকারোলি বলেন, মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব শ্রেণীভিত্তিক এবং এটি বিশেষ করে নীচু আয়ের মানুষকে প্রভাবিত করে, আর বড় কর্পোরেট ও মালিকানাধীন কোম্পানি লাভবান হয়।
২০২১-২৩ সালের মুদ্রাস্ফীতির সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকরা সুদের হার বাড়িয়েছিল। তবে এটি প্রত্যাশিত প্রভাব আনতে পারে নি। মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা হ্রাস পেলেও, শ্রম বাজারে চাপে ছিল না। উচ্চ সুদের হার শুধু বিনিয়োগকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, যা ভবিষ্যতের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলবে।
নতুন নীতি প্রয়োজন: একমাত্র পথ নয় সুদের হার
ব্লাইথ ও ফ্রাকারোলি মনে করেন, সুদের হার বাড়ানোই একমাত্র পথ নয়। তারা প্রস্তাব দেন, মূল্য নিয়ন্ত্রণ, ভর্তুকি, স্টক সংরক্ষণ এবং অতিরিক্ত লাভকর ব্যবহারের মতো হাতিয়ারও প্রয়োজন। তাদের যুক্তি, যা একটি দেশে কাজ করে, অন্য দেশে ব্যর্থ হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, স্পেনে মূল্য নিয়ন্ত্রণ কার্যকর ছিল, কিন্তু হাঙ্গেরিতে ব্যর্থ হয়েছে।
তারা প্রমাণ দেখান, অনেক অর্থনীতিবিদ ২০২১-২৩ সালের মুদ্রাস্ফীতি ভুলভাবে অনুমান করেছিলেন। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির কারণে মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে বলে মনে করা হয়েছিল, কিন্তু বাস্তবে বাস্তব বেতন কমেছে, আর কর্পোরেট লাভ বেড়েছে।
সামনের যুদ্ধ: মুদ্রাস্ফীতি এবং রাজনীতি
গ্রিফিথস, ব্লাইথ এবং ফ্রাকারোলি একমত যে, সরকারের ঋণ বৃদ্ধি এবং জলবায়ু-প্ররোচিত সরবরাহের ধাক্কা ভবিষ্যতে মুদ্রাস্ফীতিকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করবে। সামনের সময়ের মুদ্রাস্ফীতি যুদ্ধ কেবল নীতিগত নয়, রাজনৈতিক বাস্তবতারও প্রতিফলন হবে।
গ্রিফিথসের দৃষ্টিতে, নীতি এবং সামাজিক সংস্কার প্রয়োজন, যখন ব্লাইথ ও ফ্রাকারোলি প্রমাণের ভিত্তিতে এবং বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করে সমন্বিত নীতি প্রয়োগের পরামর্শ দেন। ভবিষ্যতের মুদ্রাস্ফীতি মোকাবিলা শুধু আর্থিক কৌশল নয়, এটি সমাজ, রাজনীতি, শ্রেণী এবং বাজার শক্তির সঙ্গে সমন্বয় করে নির্ধারিত হবে।
১৯৭০-এর দশক থেকে ২০২১-২৩ পর্যন্ত মুদ্রাস্ফীতির গল্প আমাদের শিখিয়েছে যে, একটি মাত্র গল্প বা একক নীতিমালা সবসময় পর্যাপ্ত নয়। ইতিহাস, রাজনৈতিক অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান এবং মানুষের প্রত্যাশাকে বোঝা প্রয়োজন। এই পাঠই আগামী দিনের নীতিনির্ধারণকে গঠন করবে।
গ্রিফিথস, ব্লাইথ এবং ফ্রাকারোলি যেভাবেই বিশ্লেষণ করেন, তারা সবাই একমত যে আগামী অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে মুদ্রাস্ফীতি আরও গুরুত্বপূর্ণ হবে। কিন্তু এর আকার, প্রভাব এবং সমাধানের পথ সম্পূর্ণ ভিন্ন হতে পারে। আগামী সময়ের মুদ্রাস্ফীতি যুদ্ধ গতকের চেয়ে একেবারেই ভিন্ন হবে।

