চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেপজা) অর্থনৈতিক অঞ্চল নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। ইতিমধ্যেই এখানে উৎপাদন ও রপ্তানি শুরু করেছে পাঁচটি বিদেশি কোম্পানি।
২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৩৩৩.৭২ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ২৩টি বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। ২০২২ সাল থেকে এ পর্যন্ত মোট ৪৮টি কোম্পানির সঙ্গে লিজ চুক্তি হয়েছে। এ চুক্তির মাধ্যমে প্রায় ১.০২৮ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ আসার কথা, যা প্রায় ১ লাখ ৩১ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করবে। এখন পর্যন্ত প্রকৃত বিনিয়োগ এসেছে ৬১.৪১ মিলিয়ন ডলার। চলতি বছরের চুক্তির আওতায় ১২টি কোম্পানি মোট ২০৮.৫৩ মিলিয়ন ডলারের প্রস্তাবিত বিনিয়োগ নিয়ে শিল্প স্থাপন করবে।
বেপজা জানিয়েছে, উৎপাদন শুরু করা পাঁচ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে চারটি চীনা ও একটি দক্ষিণ কোরিয়ার। ইতিমধ্যেই এই পাঁচ কোম্পানির রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৭.৩ মিলিয়ন ডলার। এখানে প্রায় ৪ হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। উৎপাদন শুরু করা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো:
- ফেংচুন কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল কোং (বিডি) লিমিটেড – পাদুকার অ্যাকসেসরিজ ও প্যাকেজিং সামগ্রী
- কাইসি লঞ্জারি বাংলাদেশ কোং লিমিটেড – বিভিন্ন ধরনের অন্তর্বাস ও কম্পোজিট পোশাক
- কেপিএসটি শ্যুজ (বিডি) কোং লিমিটেড – জুতার ইনসোল, আউটসোল ও ইভা ফোম
- মিংদা (বাংলাদেশ) নিউ ম্যাটেরিয়াল কোং লিমিটেড – টেক্সটাইল ও প্যাকেজিং সামগ্রী
- ইয়ংচ্যাং বিডি কোং লিমিটেড – পাদুকার আঠা ও প্রাইমার
এই প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করছে। প্রস্তাবিত মোট বিনিয়োগ ১৫৬.১৬ মিলিয়ন ডলার। আরও চারটি প্রতিষ্ঠান শিগগিরই উৎপাদন শুরু করবে। এরা হলো: গুডউড (ঢাকা) কোং লিমিটেড, জিবিন টেকনোলজি (বিডি) কোং লিমিটেড, তাইশেং (বাংলাদেশ) ওয়েবিং কোং লিমিটেড ও ইয়ংচ্যাং বিডি কোং লিমিটেড। এরা কাথ্র চামচ-কাঁটাচামচ, চিকিৎসা পণ্য, শ্যু অ্যাকসেসরিজ, অ্যাডহেসিভ, সলভেন্টস ও ইলাস্টিক সামগ্রী উৎপাদন করবে।
বেপজা নির্বাহী পরিচালক (জনসংযোগ) এ এস এম আনোয়ার পারভেজ বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশ শুল্কছাড় পাওয়ার আগেই বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়ছে।’ তিনি আরও জানান, ‘প্রকল্প চলাকালীনই পাঁচটি প্রতিষ্ঠান উৎপাদন শুরু করেছে। আরও চারটি প্রতিষ্ঠান অল্প সময়ের মধ্যে উৎপাদন শুরু করবে। আমরা ৪৮টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লিজ চুক্তি করেছি। তারা গার্মেন্টস, জুতা, জুতার সরঞ্জামাদি, ফার্মাসিউটিক্যালস, টোব্যাকো মেশিন, ড্রোনসহ উচ্চ প্রযুক্তির পণ্য তৈরি করবে।’ বেপজা কর্মকর্তাদের মতে, আরও প্রায় ১৫টি প্রতিষ্ঠান পাইপলাইনে আছে। এদের মধ্যে ৫–৭টির সঙ্গে শিগগিরই চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা। এছাড়া আরও ৩৫–৪০টি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
চুক্তি স্বাক্ষরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে চীনা বিনিয়োগকারীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এরপর রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া, শ্রীলঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর, ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, নেদারল্যান্ডস, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস, মালয়েশিয়া, আয়ারল্যান্ড ও বাংলাদেশের কোম্পানি। চীনের কাইসি গ্রুপ উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যবসা সম্প্রসারণ করছে। ২০২৪ সালের জুনে ৬০.৮৫ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগে কাইসি লঞ্জারি বাংলাদেশ কোং লিমিটেড চালু হয়। এ প্রতিষ্ঠান প্রায় ৩,৭০০ কর্মী নিয়োগ দেয়। চলতি আগস্টে তারা কাইসি গার্মেন্টস বাংলাদেশ লিমিটেড নামে আরও ৪০.০৫ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের জন্য নতুন চুক্তি করেছে। বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান ওয়েসিস অ্যাকসেসরিজ (প্রাঃ) লিমিটেডও ৪.৮ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগে কারখানা স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
ভবিষ্যতে বিনিয়োগকারীরা আসবাবপত্র, ক্যাম্পিং সরঞ্জাম, ব্যাগ, বেল্ট, চশমা, বৈদ্যুতিক বাইসাইকেল ও ট্রাইসাইকেল, সোলার প্যানেল ও পার্সোনাল কেয়ার সরঞ্জাম উৎপাদনে বিনিয়োগ করবে। বেপজা জানিয়েছে, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির ওপর পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশে নামাতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে, ভারত ও চীনের ওপর এখনও যথাক্রমে ৫০ ও ৩০ শতাংশ চড়া শুল্ক রয়েছে। এতে চীনসহ অন্যান্য দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর বাংলাদেশে কারখানা স্থাপনের আগ্রহ বেড়েছে।
বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগকারীদের বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। ভূগর্ভস্থ পানি ও গভীর নলকূপ থেকে পানি উঠিয়ে সরবরাহ হচ্ছে। একটি পানি পরিশোধনাগারও স্থাপন করা হবে। বেপজার নিজস্ব অর্থায়নে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ইতিমধ্যেই ডিআরএস স্থাপন করেছে। গ্যাস সরবরাহ পাইপলাইন স্থাপন প্রায় ৮০ শতাংশ সম্পন্ন।
বেপজা দেশে আটটি চালু রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল পরিচালনা করছে। এ সাফল্যের ওপর ভিত্তি করে মীরসরাইয়ে ১,১৩৮.৫৫ একর জমির ওপর নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল অনুমোদিত হয়। ২০১৮ সালে অনুমোদিত মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী, এখানে ৫৩৯টি শিল্প প্লট তৈরি হয়েছে। পুরো কার্যক্রম চালু হলে বিনিয়োগ হবে ৪.৫ বিলিয়ন ডলার এবং প্রায় ৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হবে। যদিও প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত, অবকাঠামো ও ইউটিলিটি সেবা দ্রুত প্রস্তুত হওয়ায় বিনিয়োগ ও রপ্তানি কার্যক্রম ইতিমধ্যেই পুরোদমে শুরু হয়েছে।

