রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ২০২২ সাল থেকে বাংলাদেশে ডলারের দাম দ্রুত বাড়তে শুরু করে। তখন প্রতি ডলারের দাম ৮৫ টাকা থেকে বেড়ে ১২২ টাকায় পৌঁছায়। এতে সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে বড় ঘাটতি তৈরি হয় এবং মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যায়। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা হয়ে পড়ে কঠিন। বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে বিপুল ডলার বিক্রি করেও দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে অর্থ পাচার রোধে কঠোর পদক্ষেপের ফলে প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয় বেড়েছে। এতে বাজারে ডলারের সরবরাহও বেড়েছে। সাধারণত এমন পরিস্থিতিতে দাম কমে আসার কথা কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক বর্তমানে বাজার থেকে ডলার কিনছে, যাতে দাম স্থিতিশীল থাকে। এর ফলে একদিকে রিজার্ভ বাড়ছে, অন্যদিকে ডলারের দামও ১২০ টাকার ওপরে অবস্থান করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিদিন বাণিজ্যিক অংশীদার দেশগুলোর মুদ্রার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে। একই সঙ্গে বাজারে ডলারের চাহিদা ও সরবরাহের সঙ্গে দামও খেয়াল করছে। এজন্য প্রতিদিন সকালে রেফারেন্স রেট প্রকাশ করা হয়। দাম রেফারেন্স রেটের নিচে নেমে গেলে নিলামের মাধ্যমে ডলার কিনছে বাংলাদেশ ব্যাংক। জুলাই থেকে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এভাবে ১৩৯ কোটি ডলার কেনা হয়েছে। এতে রিজার্ভ বেড়েছে।
গত তিন অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে ২৫ বিলিয়নের বেশি ডলার বিক্রি করা হয়েছিল, যা মূলত জ্বালানি, সার ও খাদ্য আমদানি বিল মেটাতে ব্যবহার হয়। গত বছরের আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রিজার্ভ কমে যাওয়ায় সরকারি আমদানির জন্য ডলার সহায়তা বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এ বছরের মার্চ থেকে রিজার্ভ কিছুটা বাড়তে শুরু করলে বাজার থেকে ডলার কেনা শুরু করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৩৯ কোটি ডলার কেনা হয়েছে। অতিরিক্ত ডলার থাকা ব্যাংকগুলো নিলামের মাধ্যমে তা বিক্রি করেছে। এ কারণে বর্তমানে ডলারের দাম পুরোপুরি বাজারনির্ভর হয়ে উঠেছে, যা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) অন্যতম শর্ত ছিল। এখন রিজার্ভ আইএমএফের নির্ধারিত মাত্রার চেয়েও বেশি রয়েছে। দেশে ডলার সরবরাহ বাড়াতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে প্রবাসী আয়। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে প্রবাসী আয় এসেছে ৩০ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। আগের বছরের তুলনায় এটি প্রায় ২৭ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) প্রবাসী আয় এসেছে প্রায় পাঁচ কোটি ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৮ দশমিক ৪১ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে রপ্তানি আয়ও বেড়েছে। গত অর্থবছর শেষে প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ৭২ শতাংশ। একই সময়ে আমদানি ব্যয় দাঁড়ায় ৬৮ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ২ দশমিক ৪৪ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, যদি বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে ডলার না কিনত, তাহলে দাম ১২০ টাকার নিচে নেমে যেত। এতে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় ব্যাহত হতে পারত। তাই দাম স্থিতিশীল রাখতে ডলার কেনা হচ্ছে। সাধারণত সরবরাহ বেশি হলে দাম কমে, তখন বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার কিনে বাজার ধরে রাখে এবং রিজার্ভ বাড়ায়। এখনো আমদানিতে কিছু বিধিনিষেধ থাকলেও ডলারের চাহিদা রয়েছে, তাই কেনা অব্যাহত রয়েছে।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, দীর্ঘদিনের ডলার সংকট এখন কেটে গেছে। তাই দাম পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। তাঁর মতে, দাম কমলে মুদ্রাস্ফীতি কমবে এবং সাধারণ মানুষ স্বস্তি পাবে। যদিও এতে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় কিছুটা কমতে পারে, তবুও সার্বিকভাবে দেশের জন্য তা ভালো হবে।
ডলার কেনা ও সরবরাহ বৃদ্ধির ফলে রিজার্ভ বেড়েছে। বিদেশি সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণও এতে ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, বৃহস্পতিবার রিজার্ভ ছিল ৩০ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার। তবে আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি (বিপিএম–৬) অনুযায়ী তা ২৫ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের একই সময়ে রিজার্ভ ছিল ২৫ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার, বিপিএম–৬ অনুসারে ২০ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, বর্তমানে বাজারে সরবরাহ চাহিদার চেয়ে বেশি। রপ্তানিকারক ও প্রবাসীদের স্বার্থ রক্ষায় দাম ধরে রাখতে জুলাই থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার কেনা শুরু করেছে।

