ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ের অনিয়ম-দুর্নীতির প্রভাব এখনও রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর আর্থিক চিত্রে দেখা যাচ্ছে। গত বছরের শেষে চারটি প্রধান ব্যাংকের মধ্যে দুটির বড় ধরনের লোকসান হয়েছে।
জনতা ব্যাংক বেক্সিমকো, এস আলম গ্রুপসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঋণখেলাপি হয়ে দেশের শীর্ষ লোকসানি ব্যাংকে পরিণত হয়েছে। ব্যাংকটি একাই লোকসান করেছে ৩ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। অন্যদিকে অগ্রণী ব্যাংকের লোকসান দাঁড়িয়েছে ৯৮২ কোটি টাকায়। এবারও দুই ব্যাংকের মিলিত লোকসান ৪ হাজার ৪৮ কোটি টাকা। অন্যদিকে হলমার্ক কেলেঙ্কারির পর সোনালী ব্যাংক ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ব্যাংকটি গত বছর ৯৮৮ কোটি টাকার মুনাফা করেছে। রূপালী ব্যাংকও মুনাফা করেছে ১১ কোটি টাকা। সোনালী ও রূপালী ব্যাংকের মিলিত মুনাফা দাঁড়িয়েছে ৯৯৯ কোটি টাকা।
তবে ব্যাংক চারটিই মন্দঋণের বিপরীতে যথাযথ নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখার ক্ষেত্রে নিজেদের চাহিদামতো ছাড় পেয়েছে। এর কারণে জনতা ও অগ্রণীর লোকসান কিছুটা কম দেখিয়েছে, আর সোনালী ও রূপালীর মুনাফা বেড়েছে। নিয়ম অনুযায়ী মন্দঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি ঠিকভাবে রাখলে ব্যাংকগুলোর আর্থিক চিত্র আরও খারাপ হতো। দেশে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ছয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংক রয়েছে। চারটি হলো–জনতা, অগ্রণী, সোনালী ও রূপালী। বাকি দুটি হলো বেসিক ব্যাংক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল)।
নানা অনিয়ম–দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলো দীর্ঘদিন আর্থিক সংকটে পড়ে এসেছে। বিভিন্ন সময় সরকার জনগণের করের টাকায় এই ব্যাংকগুলোর মূলধন জোগান দিয়েছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে আওয়ামী লীগ নেতাদের পাশাপাশি সরকারঘনিষ্ঠ আমলাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল রাজনৈতিক বিবেচনায়। ফলে অনিয়ম–দুর্নীতি বন্ধ হয়নি।
জনতা ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংক বর্তমানে বড় লোকসান দেখাচ্ছে। এ অবস্থায় দুই ব্যাংক একীভূত করার বিষয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়েছে। পূর্ববর্তী আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, জনতা ব্যাংকের লোকসান একাই ৩ হাজার ৬৬ কোটি টাকা, অগ্রণী ব্যাংকের ৯৮২ কোটি টাকা। সোনালী ও রূপালী ব্যাংক হলেও মুনাফা করেছে, যা ব্যাংকগুলোতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি ছাড় পাওয়ার প্রভাবকে ফুটিয়ে তোলে।
মুনাফায় শীর্ষে সোনালী ব্যাংক:
রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে সোনালী ব্যাংক কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিক মুনাফা প্রদর্শন করছে। ২০২২ সালে ব্যাংকটির মুনাফা ছিল ৩৭১ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে তা বেড়ে হয় ৬৫১ কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০২৪ সালে মুনাফা দাঁড়িয়েছে ৯৮৮ কোটি টাকায়। সোনালী ব্যাংককে এক সময় বড় ধরনের সংকটে ফেলে দিয়েছিল হল-মার্ক গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারি। ২০১২ সালে এই ঘটনা ঘটলে ব্যাংক বিপর্যয়ে পড়েছিল। সেই ধাক্কা কাটিয়ে ধীরে ধীরে সোনালী ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদে ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে হল–মার্ক গ্রুপ সোনালী ব্যাংক থেকে নানা কৌশলে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছিল। এ ছিল সে সময় দেশের ব্যাংক খাতে ঋণ অনিয়মের সবচেয়ে বড় ঘটনা। দেশজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ঋণগ্রহীতাকে জেলে যেতে হয়েছিল। এই ঋণ কেলেঙ্কারির পর সোনালী ব্যাংক পুনর্গঠন শুরু করে। ধীরে ধীরে দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক হিসেবে এর আস্থা ফিরতে শুরু করে আমানতকারীদের মধ্যে।
বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে সোনালী ব্যাংকের আমানত ছিল ৬০ হাজার কোটি টাকা। গত জুন শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকায়। একই সময়ে ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ ৩৪ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। বর্তমানে ব্যাংকের ঋণের ৩৩ শতাংশই সরকারি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দেওয়া হয়েছে। হল-মার্ক কেলেঙ্কারির পর ব্যাংক তাদের ঋণের গতি কমিয়ে দেয় এবং কৌশল পাল্টে ফেলে। আগ্রাসী ঋণ না দিয়ে ব্যাংকটি সরকারি পণ্যে বিনিয়োগ শুরু করে। পাশাপাশি বেসরকারি খাতে বড় অঙ্কের ঋণ না দিয়ে অন্য ব্যাংককে টাকা ধার দিয়ে সুদ আয়ের পথ বেছে নেয়। এতে ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি মজবুত হয়। এক যুগ আগে ব্যাংকের গ্রাহক সংখ্যা ছিল এক কোটির ঘরে। এখন তা দুই কোটি ছাড়িয়েছে।
সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শওকত আলী খান বলেন, ‘ঋণের সুদ ও ট্রেজারি খাত থেকে গত বছর আমাদের ভালো আয় হয়েছে। আয়ের বড় অংশ এসেছে ট্রেজারি খাত থেকে। অবলোপন করা ঋণ থেকেও ভালো আদায় হয়েছে, যা মুনাফায় যুক্ত হয়েছে। বেসরকারি ঋণ ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের বিপরীতে চাহিদামতো নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখার পর মুনাফা এক হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছেছে।’
রূপালী ব্যাংক: মুনাফা কমলেও নিরাপত্তা সঞ্চিতি ছাড়ে ধরা হয়েছে সাময়িক প্রভাব:
রাষ্ট্রমালিকানাধীন রূপালী ব্যাংকের মুনাফা ২০২৪ সালে কমে ১১ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। ২০২২ সালে ব্যাংকটি ২৮ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল, ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬২ কোটি টাকায়। গত বছরের শেষে ব্যাংকের আমানত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৮ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকায়, যা আগের বছর ছিল ৬৬ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। তবে ব্যাংকের ৪১ শতাংশের বেশি ঋণ খেলাপি হয়ে যাওয়ায় যেটুকু নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হতো, তা রাখলে ব্যাংক লোকসানে পড়ত। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকটিকে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণে ছাড় দিয়েছে। ফলে ২০২৪ সালে ব্যাংক ১১ কোটি টাকা মুনাফা দেখাতে পেরেছে।
রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী মো. ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, ‘খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় মুনাফা কমেছে। এসব ঋণ আদায়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। আর্থিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য আমরা কম সুদের আমানত নিয়ে ভালো ঋণ দেওয়ার চেষ্টা করছি।’
রেকর্ড লোকসানে জনতা ব্যাংক:
রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে জনতা ব্যাংক। ২০২২ সালে ব্যাংকটি ১১৩ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল। ২০২৩ সালে মুনাফা কমে দাঁড়ায় ৬২ কোটি টাকায়। তবে ২০২৪ সালে ব্যাংক রেকর্ড ৩ হাজার ৬৬ কোটি টাকা লোকসান করেছে। এটি রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক খাতের ইতিহাসে সর্বোচ্চ লোকসান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ব্যাংক প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণে ছাড় পেয়েছে। যদি খেলাপি ঋণের বিপরীতে এই সঞ্চিতি রাখা হতো, লোকসান আরও কয়েকগুণ বেশি হতো। বিদায়ী সরকারের সময় লাগামহীন ঋণ প্রদানের কারণে ব্যাংকটি এই চরম দুর্দশায় পড়েছে। ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে কয়েকজন ব্যবসায়ী সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছিলেন। ফলে ১০টি শিল্প গ্রুপের কাছে ব্যাংকের ৫৫ শতাংশ ঋণ আটকা পড়েছে। মোট ঋণখেলাপি ৬৬.৮ শতাংশ, যার পরিমাণ ৬৭ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা। অনেক ঋণ স্বাভাবিকভাবে আদায় হওয়ার সম্ভাবনা কম। গ্রাহকদের মধ্যে কেউ লাপাত্তা, কেউ জেলে আবার কারও কারখানা বন্ধ।
জনতা ব্যাংক একসময় দেশের শীর্ষ ব্যাংকের মধ্যে ছিল। দেশের অনেক শিল্পোদ্যোক্তা ব্যাংকের অর্থায়নে সফল হয়েছেন। রপ্তানি বাণিজ্যেও ব্যাংক শীর্ষে ছিল। তবে গত ১৫ বছরে বড় ধরনের ঋণ অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। এতে সংশ্লিষ্ট ছিলেন কিছু কর্মকর্তা ও আওয়ামীপন্থী পরিচালক। এখনো কারও বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ২০২৪ সালের শেষে ব্যাংকের আমানত দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৯ হাজার ৮০৯ কোটি টাকা, যা ২০২৩ সালে ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের শেষে ঋণ ছিল ৯৮ হাজার ৩৮৮ কোটি টাকা, যা ২০২৪ সালের শেষে বেড়ে ১ লাখ ৮০০ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। চলতি বছরের জুনে ব্যাংকের আমানত বেড়ে ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকার ওপরে গেছে।
জনতা ব্যাংকের শীর্ষ পাঁচ খেলাপি গ্রাহকের কাছেই আটকে আছে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের প্রায় ৭০ শতাংশ অর্থ। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় খেলাপি গ্রাহক হলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপ। জনতা ব্যাংকে বেক্সিমকো গ্রুপের মোট ঋণের পরিমাণ ২৩ হাজার কোটি টাকা। এরপর রয়েছে শেখ হাসিনা ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী এস আলম গ্রুপ, যার খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচয় দেওয়া অ্যাননটেক্স গ্রুপের খেলাপি ঋণ ৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। ক্রিসেন্টের খেলাপি ঋণ ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। থার্মেক্স গ্রুপের খেলাপি ঋণ ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এছাড়া সিকদার গ্রুপের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮৫০ কোটি টাকা।
অগ্রণী ব্যাংকও বড় লোকসানে:
অগ্রণী ব্যাংক মুনাফার দিক থেকে একসময় ভালো অবস্থানে থাকলেও ২০২৪ সালে বড় ধরনের লোকসান করেছে। ২০২২ সালে ব্যাংকটি ১১০ কোটি টাকা এবং ২০২৩ সালে ৬৯ কোটি টাকার মুনাফা করেছিল। ২০২৪ সালে লোকসান হয়েছে ৯৮২ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া, নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশনিং ঘাটতি এবং অদক্ষতাই এই লোকসানের মূল কারণ। ২০২৪ সালের শেষে ব্যাংকের আমানত ছিল ৯৯ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা, ঋণ ছিল ৭৯ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪১ শতাংশ ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে। জুনে ব্যাংকের আমানত বেড়ে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার ওপরে এবং ঋণ বেড়ে প্রায় ৭৮ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছে। জনতা ব্যাংকের মতোই অগ্রণী ব্যাংকও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিকভাবে সংযুক্ত ব্যবসায়ীদের ঋণ প্রদানের কারণে সংকটে পড়েছে।
ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবু নাসের বখতিয়ার বলেন, ‘গত ১৫ বছরে নিয়মের বাইরে যেভাবে ঋণ দেওয়া হয়েছে, এখন তা বেরিয়ে আসছে। নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণে ছাড় না নিলে লোকসান আরও বেশি হতো। প্রকৃত লোকসানের চিত্র যদি সবাই জানত, তবে পরিস্থিতি বোঝা যেত। ঋণের অনেক টাকা বাইরে চলে গেছে। ঘুরে দাঁড়াতে সময় লাগবে। গ্রাহক যারা দেশে আছেন ও ব্যবসা চালাচ্ছেন, তাঁদের আরও সহায়তা প্রয়োজন। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখলে ব্যাংক ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াবে।’