দেশের নতুন বিনিয়োগ কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে যন্ত্রপাতি আমদানি ২০–২৫ শতাংশ হ্রাস এবং নির্মাণ খাতে প্রবৃদ্ধির বড় পতনের মাধ্যমে এই পরিস্থিতির স্পষ্ট চিত্র দেখা যাচ্ছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) জানিয়েছে, বিনিয়োগ স্থবিরতার ফলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে মাত্র ৩.৯৭ শতাংশে।
এই তথ্য উঠে এসেছে সম্প্রতি পিআরআই আয়োজিত ‘মান্থলি ম্যাক্রোইকোনমিক ইনসাইটস জুন-জুলাই ২০২৫’ শীর্ষক প্রতিবেদনে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক ড. খুরশিদ আলম, প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ আক্তার হোসেন, আর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পিআরআইয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. আশিকুর রহমান।
বিনিয়োগে স্থবিরতার কারণ
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, উৎপাদন খরচের ঊর্ধ্বগতি এবং উচ্চ সুদের হার উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ আগ্রহ কমিয়েছে। এর ফলে শিল্প উৎপাদন ও অবকাঠামো খাতে নতুন প্রকল্পের গতি থমকে গেছে।
ড. আশিকুর রহমান জানান, জুন মাসে শিল্প উৎপাদনে সামান্য অগ্রগতি দেখা গেলেও তা এখনও দুর্বল। বিশেষ করে তৈরি পোশাক ও খনিজ খাত প্রত্যাশা অনুযায়ী বৃদ্ধি পায়নি। একইসাথে, জুলাই মাসে বিদ্যুৎ উৎপাদন আগের বছরের তুলনায় ১ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে মন্দার ইঙ্গিত দেয়।
পিআরআইয়ের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে যে বিনিয়োগে ধীরগতির কারণে দেশে দারিদ্র্যের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ শতাংশে, যা ২০২২ সালে ছিল ১৮.৭ শতাংশ, এবং চরম দারিদ্র্য প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
স্বস্তি বনাম সতর্ক সংকেত
অর্থনীতিতে বৈপরীত্য দেখা যাচ্ছে। একদিকে রফতানি আয় এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বৈদেশিক লেনদেনকে স্বস্তি দিচ্ছে। কিন্তু টানা তিন বছর ধরে মূলধন যন্ত্রপাতি আমদানির পতন শিল্প খাতের মন্দা ও বিনিয়োগ স্থবিরতার স্পষ্ট প্রমাণ।
অর্থনীতিবিদদের মতে, বৈদেশিক লেনদেনের স্বস্তি যতটা ইতিবাচক, শিল্প খাতে যন্ত্রপাতি আমদানির ধস ঠিক ততটাই উদ্বেগজনক। শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য এখন প্রয়োজন নীতিগত স্থিতিশীলতা, সুদের হার নিয়ন্ত্রণ, আমদানি সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করা।
যন্ত্রপাতি আমদানি ও খাতভিত্তিক বিশ্লেষণ
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ২৫.৪২ শতাংশ, আর এলসি খোলা কমেছে ২৫.৪১ শতাংশ। সহায়ক শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ১.৮৮ শতাংশ।
খাতভিত্তিকভাবে দেখা যায়:
-
গার্মেন্টস খাতে যন্ত্রপাতি আমদানি বেড়েছে ১২.৪১ শতাংশ
-
বস্ত্র খাতে কমেছে ২৫.৬৮ শতাংশ
-
ওষুধ শিল্পে কমেছে ৩৫.২৭ শতাংশ
-
চামড়া শিল্পে বেড়েছে ৮.৫৬ শতাংশ, তবে এলসি খোলা কমেছে ৪৩.৮৫ শতাংশ
একজন শিল্প গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করে বলেন, “এলসি খোলার প্রবণতা কমে যাওয়ায় উদ্যোক্তাদের মধ্যে নতুন বিনিয়োগে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছে।”
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, “মূলধন যন্ত্রপাতি আমদানির পতন স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়—নতুন বিনিয়োগে উদ্যোক্তাদের আগ্রহ কমছে। এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানে।”
ঋণ ও মুদ্রানীতি: উদ্যোক্তাদের চ্যালেঞ্জ
টানা চার বছর সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি, টাকার অবমূল্যায়ন, ডলার সংকট এবং ঋণ প্রবাহ কমে যাওয়া উদ্যোক্তাদের নিরুৎসাহিত করেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মে মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৭.১৫ শতাংশ, যা লক্ষ্যমাত্রার ৯.৫ শতাংশের অনেক নিচে। জুন মাস শেষে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে ৬.৪৯ শতাংশে, যা সাম্প্রতিক বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান মন্তব্য করেন, “উচ্চ সুদ, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করছে। মূলধন যন্ত্রপাতি আমদানিও কমেছে, যা কর্মসংস্থানের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মূলধন যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য এলসি খোলা কমেছে ২৫.৪১ শতাংশ, যার ফলে নতুন শিল্পে বিনিয়োগের গতি আরও মন্থর হয়েছে।
শিল্প খাতের দীর্ঘমেয়াদি মন্দা
২০২০ সালের করোনা মহামারির পর থেকেই শিল্প খাতে মন্দা প্রকট। এরপর বৈশ্বিক মন্দা, ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলার সংকট, ব্যাংক খাতে তারল্য ঘাটতি এবং উচ্চ সুদের হার পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর বেসরকারি বিনিয়োগে নতুন অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। ব্যাংক খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে তারল্য সংকট দেখা দেয়। ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি পেয়ে ১২–১৮ শতাংশে পৌঁছায়।
রেমিট্যান্স ও রফতানির চিত্র
বিনিয়োগ স্থবিরতার মাঝেও প্রবাসী আয় আশার সঞ্চার করেছে। আগস্ট মাসে রেমিট্যান্স ৯ শতাংশ বেড়ে ২.৪২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। জুলাই-আগস্ট মিলিয়ে দুই মাসে মোট এসেছে ৪.৯০ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ১৮.৪০ শতাংশ বেশি।
রফতানি আয় আগস্টে আগের বছরের তুলনায় ২.৯৩ শতাংশ কমলেও, জুলাই-আগস্ট মিলিয়ে মোট রফতানি আয় দাঁড়িয়েছে ৮.৬৯ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১০.৬১ শতাংশ বেশি।
আগামী চ্যালেঞ্জ
অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করে বলছেন, বিনিয়োগ স্থবিরতা কাটানো না গেলে কর্মসংস্থান সংকট, শিল্পায়ন ব্যাহত হওয়া এবং দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধি—এই তিনটি বড় ঝুঁকি দেশের সামনে দাঁড়াবে।
রফতানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ কিছুটা স্বস্তি দিলেও নতুন বিনিয়োগে স্থবিরতা দেশের ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির জন্য বড় অশনি সংকেত।
বাংলাদেশের শিল্পায়ন ও অর্থনীতির ভবিষ্যত এখন পুরোপুরি নির্ভর করছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সুদের হার নিয়ন্ত্রণ এবং নীতিগত সহায়তার ওপর। যদি এগুলো ঠিকভাবে না আসে, তবে দেশের অর্থনীতি আরও মন্থর এবং জনসাধারণের জীবনযাত্রা সংকটাপন্ন হতে পারে।

