বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের সূচনা হয় ষাটের দশকে। তবে সত্তরের দশকের শেষভাগ থেকে এটি রপ্তানিমুখী শিল্পখাত হিসেবে বিকাশ লাভ করতে শুরু করে। আশির দশকের গোড়ার দিকে ‘দেশ গার্মেন্টস’র প্রতিষ্ঠাতা নুরুল কাদের খানের উদ্যোগে বাংলাদেশ থেকে নিয়মিতভাবে পোশাক রপ্তানি শুরু হয় ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে। সেই সূচনালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত এই খাত দেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বর্তমানে তৈরি পোশাক বা আরএমজি শিল্প বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানিমুখী খাত। ২০২১–২২ অর্থবছরে এককভাবে এই খাত থেকে ৪২ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি হয়েছে, যা দেশের মোট রপ্তানির ৮১ শতাংশেরও বেশি। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO) এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বিশ্ববাজারে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ বর্তমানে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে, যেখানে চীন রয়েছে শীর্ষে।
বর্তমানে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব প্রায় ৬ দশমিক ৪ শতাংশ, যা ক্রমেই বাড়ছে। গত অর্থবছরেও বাংলাদেশ প্রায় ৩৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করে বিশ্বে নিজের অবস্থান আরও সুদৃঢ় করেছে। বাংলাদেশি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যেখানে সাম্প্রতিক সময়ে ধারাবাহিকভাবে চাহিদা বাড়ছে। এই প্রবৃদ্ধি দেশের জন্য একদিকে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের স্বস্তি এনে দিচ্ছে, অন্যদিকে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করছে।
ইউরোপীয় ব্র্যান্ডগুলোর আস্থার মূল কারণ হলো বাংলাদেশের গুণগত মান বজায় রেখে সাশ্রয়ী মূল্যে উৎপাদন করার সক্ষমতা। পাশাপাশি বিশ্ববাজারের অস্থিরতা, চীনের উৎপাদন ব্যয়ের বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের বিকল্প উৎস অনুসন্ধানের প্রবণতাও বাংলাদেশের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করছে। তবে এই সাফল্যের পাশাপাশি কিছু চ্যালেঞ্জও রয়ে গেছে। পরিবেশগত মানদণ্ড মেনে চলা, শ্রমিকদের অধিকার ও কল্যাণ নিশ্চিত করা এবং অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা দূর করা এখনো বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। বিশেষ করে বৈশ্বিক ক্রেতারা পরিবেশবান্ধব ও টেকসই উৎপাদনের দিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন, যা বাংলাদেশের জন্য একইসাথে সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ। সব মিলিয়ে ইউরোপীয় বাজারে বাংলাদেশি পোশাকের অবস্থান আজ শুধু অর্থনীতির জন্য স্বস্তির বার্তাই নয়, বরং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় দেশের শক্ত অবস্থানকেও তুলে ধরছে।
ইউরোপীয় বাজারে বাংলাদেশি পোশাকের বর্তমান অবস্থা: বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি তৈরি পোশাকশিল্প। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সবচেয়ে বড় উৎসও এই খাত। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা শুধু শিল্পখাতের জন্যই নয়, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্যও এক আশাব্যঞ্জক ইঙ্গিত।
২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ৫ মাসে ইউরোপীয় বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। গত বছরের একই সময়ে এই আয় ছিল ৮ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ মাত্র এক বছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১৭ দশমিক ৬১ শতাংশ। একই সময়ে ইউরোপে মোট রপ্তানির অর্ধেকেরও বেশি এসেছে পোশাক খাত থেকে, যা বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য। ২০২৫ সালের প্রথম ৬ মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়নে রপ্তানি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ইউরো, যা গত বছরের তুলনায় ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে অবস্থান ধরে রেখেছে, যেখানে প্রথম স্থানে রয়েছে চীন। তবে গত ১০ বছরের পরিসংখ্যান বলছে, ইউরোপীয় বাজারে বাংলাদেশের সাফল্য তুলনামূলকভাবে বেশি। ২০১৫ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ছিল ১১ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ইউরো, আর ২০২৪ সালে তা দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ইউরোতে। অর্থাৎ এই সময়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ। অন্যদিকে একই সময়ে চীনের রপ্তানি কমেছে ৪ দশমিক ১৪ শতাংশ। ইউরোপীয় বাজারে এই দ্রুত অগ্রগতি বাংলাদেশের জন্য কৌশলগত সুবিধা তৈরি করেছে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এই প্রবৃদ্ধির নেপথ্যে রয়েছে শ্রমমূল্যের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থা, ইউরোপীয় ইউনিয়নের শুল্কমুক্ত সুবিধা এবং পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানার বিকাশ। করোনা মহামারী, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ কিংবা বৈশ্বিক বাজারের অস্থিরতার মধ্যেও এই তিনটি কারণে বাংলাদেশ টিকে থাকতে পেরেছে এবং ধীরে ধীরে বাজার দখল বাড়িয়েছে। বর্তমানে দেশে ২ শতাধিক গ্রিন ফ্যাক্টরি রয়েছে, যার অনেকগুলোই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শীর্ষ পরিবেশবান্ধব কারখানা। এটি ইউরোপীয় ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলছে।
তুলনামূলকভাবে দেখা যায়, একই সময়ে পাকিস্তানের পোশাক রপ্তানি ৭ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে। এতে পোশাক খাত থেকে আয় হয়েছে ১৭ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। ভিয়েতনামের ৭১ দশমিক ৭৯ শতাংশ, কম্বোডিয়ার ৭৩ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং ভারতের ৭ দশমিক ১০ শতাংশ। তবে সামগ্রিক বাজার শেয়ারে বাংলাদেশই এখন ইউরোপের অন্যতম শীর্ষ পোশাক সরবরাহকারী।
২০১৯ সালে রপ্তানি যেখানে ছিল ১৪ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ইউরো, কোভিড–১৯ মহামারীর ধাক্কায় ২০২০ সালে তা নেমে গিয়েছিল ১২ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ইউরোতে। এরপর মাত্র ৪ বছরের ব্যবধানে ২০২৪ সালে রপ্তানি বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ইউরোতে, যা প্রবৃদ্ধির হার ৪৮ শতাংশের বেশি। একই সময়ে ইউরোপীয় বাজারে মোট পোশাক আমদানির প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ২০ শতাংশ।
২০২২–২৩ অর্থবছরে তৈরি পোশাক খাত থেকে বাংলাদেশ ৪ হাজার ৬৯৯ কোটি ডলারেরও বেশি রপ্তানি আয় করেছে। দেশের মোট রপ্তানিতে সর্বাধিক অবদান রেখেছে এই খাতই, যা বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে আবারও প্রমাণিত হয়েছে।
সাম্প্রতিক এই পরিসংখ্যান স্পষ্ট করে দিচ্ছে যে, ইউরোপীয় বাজারে বাংলাদেশের পোশাকের চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে এবং দেশটি এখন আর শুধু একটি উৎপাদনকেন্দ্র নয়, বরং বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। তবে ভবিষ্যতে এই সাফল্য ধরে রাখতে হলে পরিবেশগত মানদণ্ড, শ্রমিক কল্যাণ এবং উৎপাদন দক্ষতার উন্নয়নে আরও জোর দিতে হবে। না হলে কঠোর আন্তর্জাতিক নীতি ও প্রতিযোগিতার চাপ বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে।
ইউরোপীয় বাজারে কেন বাড়ছে চাহিদা? বর্তমানে ইউরোপীয় বাজারে বাংলাদেশি পোশাকের চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মূল কারণ হলো বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি, যা দেশটিকে ইউরোপের অন্যতম নির্ভরযোগ্য সরবরাহকারী হিসেবে পরিচিত করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্ক জটিলতা ও অস্থিরতার কারণে অনেক ক্রেতা বিকল্প উৎসের দিকে ঝুঁকেছেন। এই পরিস্থিতিতে ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশি পোশাকের অবস্থান আরও মজবুত হয়েছে।
বাংলাদেশি পোশাকের অন্যতম শক্তি হলো গুণগত মান বজায় রেখে তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী দামে সরবরাহ করা। এই কারণে ইউরোপীয় ক্রেতাদের আস্থা ক্রমেই বাড়ছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের কারখানাগুলো আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা মানদণ্ড, টেকসই উৎপাদন এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। বর্তমানে দেশে ২০০টিরও বেশি গ্রিন ফ্যাক্টরি রয়েছে, যেগুলোর অনেকগুলো বিশ্বের সেরা পরিবেশবান্ধব কারখানার স্বীকৃতি পেয়েছে। এসব উদ্যোগ বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকে আন্তর্জাতিক বাজারে আরও প্রতিযোগিতামূলক করে তুলেছে।
এছাড়া চীন, ভারত ও অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ ইউরোপে স্থিতিশীল সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার, দক্ষ শ্রমশক্তি এবং দ্রুত সরবরাহ ব্যবস্থার কারণে ইউরোপীয় ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশের উপর নির্ভরতা বাড়িয়েছে। তাছাড়া বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও বাংলাদেশ সময়মতো অর্ডার ডেলিভারি দিতে পারায় ক্রেতাদের কাছে একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে নতুন শুল্ক আরোপের চাপ, ইউরোপীয় ক্রেতাদের আস্থা, গুণগত মান ও সাশ্রয়ী দাম, পরিবেশবান্ধব উৎপাদন এবং সরবরাহ ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা, এই সব কারণেই ইউরোপে বাংলাদেশি পোশাকের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে।
ইউরোপীয় বাজারে বাংলাদেশি পোশাকের গুরুত্ব: বর্তমানে ইউরোপীয় বাজারে বাংলাদেশি পোশাকের গুরুত্ব আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই খাতের প্রধান গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। শুধু ২০২২–২৩ অর্থবছরেই ইউরোপীয় বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি প্রায় ৫৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১৮ বিলিয়ন ইউরোর বেশি হয়েছে। এই প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রত্যক্ষ অবদান রাখছে এবং দেশের বৈদেশিক মুদ্রার আয়ের সবচেয়ে বড় উৎসকে আরও শক্তিশালী করছে।
বাংলাদেশি পোশাকশিল্পের প্রতি ইউরোপীয় ব্র্যান্ডগুলোর আস্থার অন্যতম কারণ হলো টেকসই উৎপাদন ব্যবস্থা এবং পরিবেশবান্ধব কারখানার বিকাশ। বর্তমানে বাংলাদেশে বিশ্বের সর্বাধিক সংখ্যক গ্রিন ফ্যাক্টরি রয়েছে, যেগুলোর অনেকগুলো আন্তর্জাতিকভাবে সর্বোচ্চ মানের সার্টিফিকেশন পেয়েছে। এতে শ্রমিকদের নিরাপত্তা, পরিবেশের সুরক্ষা এবং টেকসই উৎপাদন নিশ্চিত হচ্ছে, যা ইউরোপীয় ক্রেতাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফলে বাংলাদেশ শুধু কম দামি পোশাক সরবরাহকারী দেশ হিসেবে নয়, বরং মানসম্পন্ন ও উচ্চমূল্যের পোশাক রপ্তানির মাধ্যমেও বাজারে অবস্থান শক্ত করেছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের জন্য একটি বিশাল বাজার, যেখানে মোট রপ্তানির প্রায় অর্ধেকই গিয়ে থাকে। এই বাজারে এইচঅ্যান্ডএম, জারা, গ্যাপের মতো বড় আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড তাদের বিপুল অর্ডার পূরণের জন্য বাংলাদেশের উপর নির্ভর করছে। ক্রেতাদের এই আস্থা বাংলাদেশের শিল্পখাতকে শুধু ইউরোপেই নয়, বৈশ্বিক বাজারেও প্রতিযোগিতামূলক করে তুলছে।
অর্থনীতির দিক থেকে পোশাক ও বস্ত্রশিল্প বাংলাদেশের জিডিপিতে প্রায় ১৩ শতাংশ অবদান রাখে এবং দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগ এনে দেয়। এই খাত প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করেছে, যার অধিকাংশই নারী। ফলে পোশাকশিল্প শুধু বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন নয়, নারীর ক্ষমতায়ন ও সামাজিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, ইউরোপীয় বাজারে বাংলাদেশি পোশাকের প্রবৃদ্ধি দেশের অর্থনীতিতে নতুন গতি সঞ্চার করছে। টেকসই উৎপাদন, সাশ্রয়ী দাম, আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোর আস্থা এবং ক্রমবর্ধমান বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ক্রমেই ইউরোপের জন্য একটি অপরিহার্য সরবরাহকারী দেশে পরিণত হচ্ছে। এই প্রবণতা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, সঠিক পরিকল্পনা ও নীতিগত সহায়তা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশি পোশাকশিল্প আগামী দিনগুলোতে বৈশ্বিক বাজারে আরও শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পারবে।
বর্তমানে ইউরোপীয় বাজারে বাংলাদেশি পোশাকের ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ: বর্তমানে ইউরোপীয় বাজারে বাংলাদেশি পোশাকের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ যখন স্বল্পোন্নত দেশ (LDC) থেকে উত্তরণ করবে, তখন ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অন্যান্য দেশে শুল্কমুক্ত সুবিধা হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে। এর ফলে রপ্তানি খরচ বাড়বে এবং বাজারে প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হয়ে উঠবে। চীনের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোও ইউরোপীয় বাজারে প্রবেশের চেষ্টা করছে, যা বাংলাদেশের জন্য বাজার ধরে রাখা কঠিন করে তুলছে।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতা, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, যুদ্ধ পরিস্থিতি ও ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ইউরোপীয় ক্রেতাদের চাহিদা হ্রাস পেয়েছে। এর ফলে অনেক কারখানায় অর্ডার কমে গেছে, যা উৎপাদন প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করছে এবং শ্রমিক ছাঁটাই ও আয় হ্রাসের ঝুঁকি তৈরি করেছে।
অন্যদিকে টেকসই উৎপাদন ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে সম্মতি (compliance) বজায় রাখা নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে সামনে এসেছে। ইউরোপীয় ক্রেতারা এখন পরিবেশবান্ধব, ন্যায়সঙ্গত ও টেকসইভাবে উৎপাদিত পোশাককে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। বাংলাদেশের শিল্পখাতকে এই মানদণ্ড পূরণ করতে হবে, না হলে ক্রেতাদের আস্থা কমে যেতে পারে।
ভিত্তি হিসেবে দেশের অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জও বড় উদ্বেগের কারণ। ডলারের ঘাটতি, জ্বালানি সংকট, সরবরাহ শৃঙ্খলে বিঘ্ন, শ্রমিক অসন্তোষ এবং কম বেতনের ওপর নির্ভরশীল কর্মপরিবেশ, এগুলো উৎপাদন খরচ ও মানদণ্ডে প্রভাব ফেলছে। এছাড়া বাংলাদেশের রপ্তানি এখনো মূলতঃ তৈরি পোশাকের উপর নির্ভরশীল, যা বৈশ্বিক বাজারের অস্থিরতার সঙ্গে সরাসরি ঝুঁকিপূর্ণ। রপ্তানি বৈচিত্র্য না আনলে এই ঝুঁকি দীর্ঘমেয়াদে কমানো সম্ভব নয়।
পোশাক রপ্তানির প্রায় ৭০ শতাংশ পশ্চিমা বাজারের ওপর নির্ভরশীল। বিশেষজ্ঞরা জানান, পশ্চিমা বাজারের ওপর একক নির্ভরতা পোশাক খাতের বড় চ্যালেঞ্জ। এতে নির্দিষ্ট বাজারে চাহিদা কমে গেলে কিংবা আমদানিকারক এবং রপ্তানিকারক দেশের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হলে সেখানে রপ্তানি কমে বন্ধও হয়ে যেতে পারে। তখন এই খাতে বিপদ বাড়বে। সব মিলিয়ে ইউরোপীয় বাজারে বাংলাদেশি পোশাকের জন্য সুযোগ যেমন বড়, তেমনি ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জও অস্বীকারযোগ্য নয়। এগুলো মোকাবেলা করতে হলে উৎপাদন দক্ষতা বাড়ানো, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব মান বজায় রাখা, শ্রমিক কল্যাণ নিশ্চিত করা এবং বৈচিত্র্যময় রপ্তানি বাজার গড়ে তোলা অপরিহার্য।
এক্ষেত্রে আমাদের করণীয়: বাংলাদেশি পোশাক শিল্পকে বৈশ্বিক বাজারে টেকসই ও প্রতিযোগিতামূলক রাখতে হলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নেওয়া অপরিহার্য। প্রথমত: রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনা দরকার। শুধুমাত্র ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো নির্দিষ্ট বাজারের ওপর নির্ভর না থেকে নতুন বাজার খুঁজে বের করা এবং পণ্যের বহুমুখীকরণ করা দেশের জন্য ঝুঁকি কমাতে সহায়ক হবে। দ্বিতীয়ত: পণ্যের মান ও ডিজাইন উন্নত করতে হবে। কম খরচে উৎপাদন থেকে বেরিয়ে এসে উচ্চমানের পোশাক এবং নতুন ধরনের ডিজাইন বাজারে আনা গেলে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের মধ্যে বাংলাদেশি পোশাকের গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়বে।
তৃতীয়ত: শ্রমিকদের অধিকার ও কর্মপরিবেশ উন্নয়ন করাও জরুরি। কম বেতন এবং দুর্বল কর্মপরিবেশের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে শ্রমিকদের নিরাপদ ও উন্নত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা দেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদে সুবিধাজনক হবে। চতুর্থত: উৎপাদনশীলতা ও মান বৃদ্ধির জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন গ্রহণ অপরিহার্য। কারখানাগুলোকে নতুন প্রযুক্তি ও স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে, যাতে উৎপাদন খরচ কমানো যায় এবং পণ্যের গুণগত মান উন্নত হয়।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের নতুন নীতিমালা অনুসরণ করে কারখানাগুলোকে টেকসই উৎপাদন ও নৈতিক মানদণ্ড পূরণের জন্য প্রস্তুত করা দরকার। এটি শুধু বাজারে আস্থা বাড়াবে না, বরং বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে সাহায্য করবে।
অপরদিকে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকারের সময়োপযোগী ও কার্যকর কূটনৈতিক উদ্যোগও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান সুরক্ষিত রাখতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, বাণিজ্যিক চুক্তি ও সহযোগিতার মাধ্যমে নতুন সুবিধা অর্জন করা যেতে পারে। এই উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন করলে বাংলাদেশি পোশাক শিল্প শুধু বর্তমান চাহিদা পূরণ করবে না, বরং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টেকসইভাবে অগ্রগতি অর্জন করতে পারবে।
ইউরোপীয় বাজারে বাংলাদেশি পোশাকের চাহিদা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক সংকেত। গুণগত মান, সাশ্রয়ী মূল্য, পরিবেশবান্ধব উৎপাদন ও শ্রমিকদের দক্ষতা আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থা বাড়িয়েছে। পাশাপাশি বৈশ্বিক বাজারের অস্থিরতা এবং চীনের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ নতুন সুযোগও অর্জন করেছে।
তবে এই সাফল্যের সঙ্গে কিছু ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জও যুক্ত হয়েছে, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পর শুল্ক সুবিধা হারানো, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা, শ্রমিক কল্যাণ ও পরিবেশগত মানদণ্ডের চাপ এসব খাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেক্ষেত্রে রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনা, পণ্যের মান ও ডিজাইন উন্নত করা, শ্রমিক অধিকার নিশ্চিত করা এবং আধুনিক প্রযুক্তি ও টেকসই উৎপাদনে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা অপরিহার্য। পরিশেষে বলা যায় সঠিক নীতি, কৌশল এবং আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প শুধু ইউরোপীয় বাজারেই নয়, বৈশ্বিক বাণিজ্যে টেকসই ও প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হবে। এই খাত দেশের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানে দীর্ঘমেয়াদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে থাকবে।