আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে শুধু গত জুন মাসেই বাংলাদেশ ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ পেয়েছে। এতে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১২ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার বা ১১ হাজার ২১৫ কোটি ডলার। টাকার অঙ্কে যা ১৩ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকার বেশি। তিন মাস আগের তুলনায় ঋণ বেড়েছে ৭৩৫ কোটি ডলার, যা প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেসরকারি খাতে ঋণ কমলেও সরকারি খাতে ঋণ বৃদ্ধির কারণে এ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিগত সরকারের সময়ে সবচেয়ে বড় চাপ ছিল ডলার বাজারে। ডলারের দামের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিই মূল্যস্ফীতির অন্যতম কারণ ছিল। তবে এখন মূল্যস্ফীতি কমার প্রধান কারণ ডলার দরে স্থিতিশীলতা। আগের সরকারের সময়ে ডলারের সংকটের কারণে বিদেশিদের কাছে বকেয়া বেড়েছিল। ভারতের আদানি গ্রুপসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছিল। কিন্তু গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর অর্থ পাচার রোধে কঠোর পদক্ষেপ নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রেকর্ড ৫৭০ কোটি ৪৫ লাখ ডলার ঋণ পরিশোধ হয়েছে। আগের অর্থবছরে এই পরিমাণ ছিল ৪৭৯ কোটি ৫৪ লাখ ডলার। ঋণ পরিশোধ বাড়লেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে।
গত অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছে রেকর্ড ৩০ বিলিয়ন ডলার। রপ্তানি আয়েও হয়েছে প্রায় ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি। এর সঙ্গে কম সুদের বিদেশি ঋণ যোগ হওয়ায় ডলার বাজারে স্বস্তি ফিরেছে। জুন শেষে গ্রস রিজার্ভ দাঁড়ায় ৩১ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার এবং বিপিএম–৬ হিসেবে দাঁড়ায় ২৬ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার। প্রায় তিন বছরের মধ্যে যা সর্বোচ্চ। ডলারের দর ১২২ টাকার মধ্যে স্থিতিশীল থাকলেও একসময় কমে ১১৯ টাকা ৫০ পয়সায় নেমেছিল। তবে রেমিট্যান্স ও রপ্তানির প্রবাহ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেই কারণে উদ্বৃত্ত ডলার কিনে নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি অর্থবছরেই বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ১৭৪ কোটি ৭৫ লাখ ডলার কিনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আকুর দায় শোধের পরও রিজার্ভ ফের ৩১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
জুন শেষে বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ কমে দাঁড়িয়েছে ১৯ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। তিন মাস আগে যা ছিল ১৯ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলার। বিপরীতে সরকারি খাতে ঋণ বেড়ে হয়েছে ৯ হাজার ২৩৮ কোটি ডলার, যা তিন মাস আগে ছিল ৮ হাজার ৪৯২ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, পাচার কমে যাওয়ায় রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বেড়েছে। ফলে এখন রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি নয় বরং কিনতে পারছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে রিজার্ভও বাড়ছে। এ ধারা বজায় থাকলে ডলার বাজারে স্থিতিশীলতা আরও দীর্ঘস্থায়ী হবে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করিয়ে দেন, করোনা-পরবর্তী সময়ে নীতি শিথিলতার সুযোগে ব্যাপক অর্থ পাচার হয়েছিল। ২০২১ সালে যেখানে ডলারের দাম ছিল ৮৪ টাকা, সেখানে আওয়ামী লীগ সরকার বিদায়ের সময় তা দাঁড়ায় ১২২ টাকায়। আবার ২০২১ সালের আগস্টে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড ৪৮ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছালেও পরবর্তীতে অর্ধেকের বেশি কমে ২০২৩ সালের আগস্টে নেমে যায় ২০ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলারে। সেখান থেকে ফের বেড়ে বর্তমানে ২৬ দশমিক শূন্য ৮ বিলিয়ন ডলারে উঠেছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়। তাদের হিসাব অনুযায়ী, গত ১৬ বছরে দেশ থেকে পাচার হয়েছে ২৩৪ কোটি ডলার।

