গত দেড় দশকে রংপুর অঞ্চলের কৃষি পুরোপুরি বদলে গেছে। শস্য বহুমুখী হয়েছে, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, উন্নত বীজ, সার-কীটনাশক সরবরাহ এবং সেচ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে ফসলের ঘনত্ব বেড়েছে। আলু, ধান, ভুট্টা, শাকসবজি ও ফলমূলসহ নতুন ফসল উৎপাদনের প্রতি কৃষকের আগ্রহ বাড়ায় অঞ্চলটির কৃষিনির্ভর অর্থনীতি শক্তিশালী হয়েছে।
তবে কৃষকের ভাগ্য এখনও অপরিবর্তিত। ঋণ নিয়ে ফসল উৎপাদন বাড়ালেও কাঙ্ক্ষিত মূল্য পাচ্ছেন না তারা।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, অপরিকল্পিত উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থাপনার কারণে কৃষক তাদের ফসলের সঠিক দাম পাচ্ছেন না। চাহিদা নিরূপণ না করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কৃষকদের উৎসাহিত করছে। ফলে বাজারে পণ্যের আধিক্য বেড়ে দাম কমে যাচ্ছে। উদ্বৃত্ত ফসল সংরক্ষণের কার্যকর ব্যবস্থা না থাকায় কৃষক বাধ্য হয়ে কম দামে বিক্রি করছেন।

রংপুরের পীরগাছা উপজেলার তাম্বলপুর ইউনিয়নের রহমত চরের কৃষক মো. সুলেমান আলী বলেন, ‘আমন ধান উঠার সময় বর্ষাকাল। মধ্যস্বত্বভোগীরা সুযোগ নিয়ে ধান ভেজা থাকার অজুহাতে কম দামে কিনে নেয়। ধারদেনা করে আবাদ করি। ধান কাটার সময় ধারের টাকা পরিশোধের চাপ থাকে। বাধ্য হয়ে অর্ধেক দামে বিক্রি করতে হয়।’
তিনি মৌসুমভিত্তিক সবজিও আবাদ করেন। যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ হওয়ায় কাছাকাছি বাজারে কম দামে বিক্রি করতে হয়।
মিঠাপুকুর উপজেলার রানীপুকুর ইউনিয়নের এলুয়াচড়া পানবাড়ি এলাকার কৃষক হাজি মো. হাফিজুর রহমান বলেন, ‘পরিকল্পিত বাজার ব্যবস্থা না থাকায় প্রান্তিক কৃষক সবসময় ফসলের প্রত্যাশিত মূল্য পাচ্ছেন না।’
এ বছর তিনি ২২ বিঘা জমিতে আলু আবাদ করেন। মৌসুমের শুরুতে ১২ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। বেশি লাভের আশায় হিমাগারে রাখেন। কিন্তু নতুন আলু বাজারে আসার আগে এখনও প্রতি কেজি আলু ১২ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। হিমাগারের খরচ ৬ টাকা কেজি এবং অন্যান্য খরচ বাদ দিলে প্রতি কেজি আলুর লাভ পড়ে মাত্র ৫ টাকা।
হাফিজুর রহমান অভিযোগ করেন, ‘সরকার হিমাগার গেটে প্রতি কেজি আলুর দাম ২২ টাকা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু কোথাও তা মানা হচ্ছে না। খুচরা বাজারে একই আলু ১৮-২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।’
সবজির ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। লাউ ও বেগুন আবাদ হলেও পাইকার না আসায় কম দামে বিক্রি করতে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এলাকায় যদি সবজি হিমাগার থাকত, তাহলে উদ্বৃত্ত শস্য সংরক্ষণ করে ভালো দাম পাওয়ার সময় বিক্রি করা যেত।’
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ মৌসুমে জেলায় আলু আবাদ হয়েছে ৬৬,২৮০ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন হয়েছে ১৯ লাখ ৫৫ হাজার টন, যেখানে চাহিদা মাত্র ১ লাখ ১৮,৬৬৫ টন। অর্থাৎ ১৮ লাখ ৩৭,৬৫৫ টন আলু বেশি উৎপাদন হয়েছে।
চালের বার্ষিক চাহিদা ৫ লাখ ১০,২০৫ টন, উৎপাদন হয়েছে ১২ লাখ ৩২,৭০১ টন। শাকসবজির চাহিদা ১ লাখ ১৮,৬৬৬ টন, উৎপাদন হয়েছে ৭ লাখ ৫৫,১৪ টন। ভুট্টার উৎপাদন হয়েছে ৩ লাখ ৯১,০২১ টন।

ফসলের কাঙ্ক্ষিত মূল্য না পাওয়ার কারণ হিসেবে রংপুর আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (অবসরপ্রাপ্ত) উদ্যান বিশেষজ্ঞ মো. মেসবাহুল ইসলাম বলেন, ‘এলাকাভিত্তিক উপযোগী শস্য উৎপাদন ব্যবস্থা দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি। যদি এটি থাকত, আলুর মূল্য বিপর্যয় হতো না। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আলুর চাহিদা নিরূপণ করে নির্দিষ্ট জমিতে আবাদের জন্য কৃষককে উৎসাহিত করত। তখন কৃষকও প্রত্যাশিত দাম পেতেন।’
তিনি আরও বলেন, মুক্তবাজারের সঠিক নিয়ম-কানুন কাজ করছে না, বীজনীতি ও হাইব্রিড বীজ মনিটরিং যথাযথভাবে হচ্ছে না। চর থেকে মূল ভূখণ্ডে অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার সুযোগ নিচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। জলবায়ু পরিবর্তনের উপযোগী বীজ এবং দুর্যোগ সহনশীল জাত প্রান্তিক পর্যায়ে ব্যবহার হচ্ছে না।
মেসবাহুল ইসলাম বললেন, ‘কৃষি বীমা চালু করতে হবে। প্রান্তিক কৃষক বীমার আওতায় আসা উচিত। কৃষিপণ্য রফতানির জন্য উত্তম কৃষিচর্চায় প্রান্তিক কৃষককে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ঢাকায় কৃষিপণ্য আনার পরিবহনও সহজ করতে হবে।’

