জুলাইয়ে সিউল ও ওয়াশিংটন মৌখিকভাবে একটি বাণিজ্য চুক্তিতে সম্মত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের শর্ত অনুযায়ী শুল্ক কমানো হবে, বিনিময়ে দক্ষিণ কোরিয়াকে যুক্তরাষ্ট্রে ৩৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে হবে। তবে বিনিয়োগের ধরন ও শর্ত নিয়ে মতপার্থক্যের কারণে এখনো লিখিত চুক্তি হয়নি।
এ চুক্তি বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান দাবি মেনে নিলে দক্ষিণ কোরিয়া ১৯৯৭ সালের মতো ভয়াবহ আর্থিক সংকটে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট লি জে মিয়ং। গত শুক্রবার রয়টার্সকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ মন্তব্য করেন। লি বলেন, ‘কারেন্সি সোয়াপ ছাড়া যদি আমরা ৩৫০ বিলিয়ন ডলার নগদে সরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ করি, তবে দক্ষিণ কোরিয়া ১৯৯৭ সালের সংকটের মতো পরিস্থিতিতে পড়বে।’
আজ সোমবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেবেন প্রেসিডেন্ট লি। তিনি প্রথম দক্ষিণ কোরিয়ান প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিরাপত্তা পরিষদের সভায় সভাপতিত্ব করবেন। তবে সফরসূচিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক নেই, আলোচনার এজেন্ডায়ও বাণিজ্য নেই। লি বলেন, তার উদ্দেশ্য হলো বিশ্বকে জানানো যে ‘গণতান্ত্রিক কোরিয়া ফিরে এসেছে।’ জুনের স্ন্যাপ নির্বাচনে তিনি ক্ষমতায় আসেন। তার রক্ষণশীল পূর্বসূরি ইউন সুক ইয়োল সামরিক আইন জারির কারণে অপসারিত হয়ে কারাগারে আছেন।
গত আগস্টে ট্রাম্পের সঙ্গে প্রথম শীর্ষ বৈঠকে কোনো যৌথ বিবৃতি না হলেও লি দাবি করেন, তাদের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক মজবুত হয়েছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষ জর্জিয়ার হুন্ডাই ব্যাটারি কারখানায় অভিযান চালিয়ে ৩০০-র বেশি কোরিয়ান শ্রমিককে আটক করে। শ্রমিকদের হাতকড়া পরা ছবি প্রকাশ করে ট্রাম্প প্রশাসন। এতে দক্ষিণ কোরিয়ায় ক্ষোভ ছড়ায়। লি বলেন, কোরিয়ানরা কঠোর আচরণে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তবে এটি ট্রাম্পের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সিদ্ধান্ত নয়, বরং অতিউৎসাহী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের কাজ। তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্র এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছে এবং ভবিষ্যতে যুক্তিসঙ্গত পদক্ষেপ নেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এমনকি ট্রাম্প শ্রমিকদের থাকতে দেয়ার প্রস্তাবও দিয়েছেন। লির মতে, এ ঘটনায় দুই দেশের মিত্রতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।

এদিকে মার্কিন বাণিজ্যমন্ত্রী হাওয়ার্ড লুটনিক বলেন, দক্ষিণ কোরিয়াকে জাপানের মতোই একটি চুক্তি মেনে নিতে হবে, নতুবা শুল্ক দিতে হবে। ট্রাম্প প্রশাসনের দাবি, এ শুল্ক বিদেশি সরকারগুলো দিচ্ছে, যদিও বাস্তবে তা বহন করছে মার্কিন আমদানিকারকরা। লুটনিকের বক্তব্যের জবাবে লি বলেন, রক্তের মতো সম্পর্কিত মিত্রদের মধ্যে ন্যূনতম যুক্তিবোধ বজায় থাকবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন।
দক্ষিণ কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি বৈদেশিক মুদ্রা সোয়াপ লাইন খোলার প্রস্তাব দিয়েছে, যাতে বিনিয়োগের ধাক্কা স্থানীয় বাজারে না পড়ে। লি বলেন, জাপানের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ দক্ষিণ কোরিয়ার দ্বিগুণের বেশি। ইয়েন আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃত এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সোয়াপ লাইনও রয়েছে। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার পরিস্থিতি ভিন্ন। লি জানান, দুই দেশ লিখিতভাবে সম্মত যে যেকোনো বিনিয়োগ প্রকল্প বাণিজ্যিকভাবে কার্যকর হতে হবে। তবে বিশদ শর্ত ঠিক করাই এখন সবচেয়ে বড় বাধা। বর্তমান প্রস্তাবগুলো বাণিজ্যিক যুক্তিসঙ্গততা নিশ্চিত করছে না। প্রতিরক্ষায় দক্ষিণ কোরিয়ার বাড়তি অবদান নিয়ে কোনো মতবিরোধ নেই। তবে ওয়াশিংটন চায় নিরাপত্তা ও বাণিজ্য আলোচনা আলাদা রাখতে।
লি বলেন, ‘আমাদের এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি যত দ্রুত সম্ভব শেষ করতে হবে।’ তিনি জানান, উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে চেষ্টা করলেও এখনো কোনো ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। তাই আপাতত আন্তঃকোরীয় আলোচনার সম্ভাবনা নেই। লি ট্রাম্পকে উৎসাহ দিয়েছেন, আগামী মাসে দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠেয় এশিয়া-প্যাসিফিক সম্মেলনে কিম জং উনের সঙ্গে বৈঠক করতে। তবে সিউলের কাছে এখনো ওয়াশিংটন-পিয়ংইয়ং আলোচনার কোনো নির্দিষ্ট তথ্য নেই।
কিম জং উন, ভ্লাদিমির পুতিন ও শি জিনপিংয়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রসঙ্গে লি বলেন, এখন সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর জোট ও পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক দেশগুলোর জোট মুখোমুখি অবস্থায়। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে দক্ষিণ কোরিয়া এ প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাঝখানে পড়ে গেছে। লি সতর্ক করেন, যুক্তরাষ্ট্র-জাপান-দক্ষিণ কোরিয়ার সহযোগিতা যত বাড়ছে, ততই ঘনিষ্ঠ হচ্ছে চীন-রাশিয়া-উত্তর কোরিয়ার সম্পর্ক। এটি কোরিয়ার জন্য বিপজ্জনক। তাই ক্রমবর্ধমান সামরিক উত্তেজনা থেকে বেরিয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের উপায় খুঁজে বের করতে হবে।