বাংলাদেশ হংকং আন্তর্জাতিক কনভেনশন ফর দ্য সেফ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টালি সাউন্ড রিসাইক্লিং অব শিপস (হংকং আন্তর্জাতিক কনভেনশন ২০০৯) বাস্তবায়নের সময়সীমা পেরিয়ে গেছে। ২০২৩ সালের জুনে বাংলাদেশ এ কনভেনশন অনুসমর্থন করলেও ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত কার্যকর করার কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
মেরিটাইম এক্সিকিউটিভ এর এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সামাজিক-অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জকে অজুহাত করে কনভেনশন কার্যকর করতে বিলম্ব করতে পারে। এমনকি তারা ১৯৯২ সালের রিও ডিক্লারেশনের মতো আন্তর্জাতিক ঘোষণার দিকেও ইঙ্গিত করছে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কোনো দেশ একবার আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুসমর্থন করলে সেটি আইনগতভাবে মানা বাধ্যতামূলক। ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী, এই দায় এড়ানো সম্ভব নয়। রিও ডিক্লারেশনের মতো নন-বাইন্ডিং ঘোষণা কোনোভাবেই হংকং আন্তর্জাতিক কনভেনশন -এর মতো বাধ্যতামূলক চুক্তিকে অকার্যকর করতে পারে না।
বর্তমানে জাহাজ ভাঙা শিল্প পরিচালিত হচ্ছে ২০১১ সালের জাহাজ ভাঙা ও পুনর্ব্যবহার বিধিমালা ২০১১ এবং ২০১৮ সালের শিপ রিসাইক্লিং আইন ২০১৮-এর আওতায়। এসব আইনের অধীনে শিপ রিসাইক্লিং বোর্ড আনুষ্ঠানিক কর্তৃপক্ষ হলেও গুরুতর জনবল সংকটে তারা কার্যক্রম চালাতে পারছে না। ফলে দৈনন্দিন প্রশাসনিক কাজ, যেমন অনুমতি বা এনওসি দেওয়ার দায়িত্ব পালন করছে শিল্প মন্ত্রণালয়ের শিপ রিসাইক্লিং উইং। এখন দায়িত্ব হস্তান্তরের প্রক্রিয়ায় আছে, কিন্তু প্রশাসনিক সক্ষমতার অভাব নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। শিপব্রেকিং ইয়ার্ডগুলো বিপুল মূলধন ব্যয় করে জাহাজ কিনে থাকে। অনুমতি প্রদানে বিলম্ব হলে ব্যাংক সুদ জমে অর্থনৈতিক ক্ষতির ঝুঁকি বাড়ে।
হংকং আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুনের পর থেকে কোনো ইয়ার্ড “গ্রিন ইয়ার্ড” সনদ ছাড়া জাহাজ ভাঙতে পারবে না। এখন পর্যন্ত মাত্র সাতটি ইয়ার্ড যেমন পিএইচপি,এসএন করপোরেশন, কাবির রিসাইক্লিং, আরব রিসাইক্লিং ও কে-আর রিসাইক্লিং সনদ পেয়েছে। আরও ১৫টি ইয়ার্ড আপগ্রেড করছে। তবে বেশিরভাগ ইয়ার্ডই মানদণ্ড পূরণ করতে পারেনি। এসব ইয়ার্ডে হাজার হাজার শ্রমিক কাজ করে এবং দেশের ইস্পাত, আসবাবপত্রসহ নানা শিল্পে লাখ লাখ মানুষের জীবিকা নির্ভরশীল। সবুজ ইয়ার্ডে সীমিত করা হলে শ্রমিকদের কর্মসংস্থান সংকটে পড়বে। পাশাপাশি জাহাজ ভাঙার ইস্পাত না পেলে দেশকে কাঁচামাল আমদানি করতে হবে, যা বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ ফেলবে।
বিশ্বব্যাপী জাহাজ ভাঙা শিল্প ইউরোপ থেকে এশিয়ায় সরেছে মূলত শিথিল নিয়মকানুনের কারণে। বাংলাদেশ যদি এককভাবে কঠোর নিয়ম কার্যকর করে, তবে পাকিস্তান, ভারত বা ফিলিপাইন ব্যবসা কেড়ে নিতে পারে। ফলে বাজার শেয়ার কমে যাবে।
জাহাজ ভাঙা থেকে আসা বিপজ্জনক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য জাপানের সহায়তায় একটি ‘চিকিৎসা, সংরক্ষণ ও নিষ্পত্তি সুবিধা’ নির্মাণের কাজ চলছে কিন্তু জমি অধিগ্রহণে দেরি হওয়ায় ২০২৫ সালের মধ্যে এ সুবিধা চালু হওয়ার সম্ভাবনা কম। এতে নিরাপদ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, হংকং আন্তর্জাতিক কনভেনশন জাহাজ মালিকদের বদলে জাহাজ ভাঙা দেশগুলোকেই বেশি দায়িত্ব দেয়। ইয়ার্ডগুলোকে নিরাপদ অবকাঠামো তৈরি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সুবিধা স্থাপন, সেফটি প্ল্যান তৈরি ও শ্রমিকদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হয় কিন্তু মালিকরা শেষ সময়ে জাহাজের পতাকা বদলে বা ক্যাশ বায়ারের কাছে বিক্রি করে দায় এড়ায়। এতে দায়িত্বের ভার পড়ে শুধু রিসাইক্লিং দেশগুলোর ওপর।
মূল প্রশ্ন হলো—বাংলাদেশ কি সত্যিই ২০২৫ সালের সময়সীমার মধ্যে হংকং আন্তর্জাতিক কনভেনশন বাস্তবায়নে প্রস্তুত? অপ্রস্তুত থাকা বা সামাজিক-অর্থনৈতিক কারণ দেখিয়ে দায় এড়ানো আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের শামিল হবে। অনুসমর্থন করার মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তাই সৎভাবে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এ বিষয় শুধু আইনি নয়, শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও পরিবেশ রক্ষার সঙ্গেও জড়িত।
সমাধানের প্রস্তাবনা:
১. আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক সংস্থা পুনর্ব্যবহারকারী দেশগুলোর বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে হংকং আন্তর্জাতিক কনভেনশন-তে কার্যকর কিন্তু সহজ মানদণ্ড তৈরি করতে পারে।
২. আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক সংস্থা-কে এসব দেশে শ্রমিক সুরক্ষা ও পরিবেশগত মান যাচাইয়ের জন্য শক্তিশালী মনিটরিং ব্যবস্থা নিতে হবে।
৩. প্রযুক্তিগত সহায়তার পাশাপাশি আর্থিক সহায়তাও জরুরি। যেমন, নিরাপত্তা সরঞ্জাম, আধুনিক যন্ত্রপাতি কেনা ও প্রশিক্ষণে সহায়তা দরকার। আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক সংস্থার নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব জাহাজ পুনর্ব্যবহার কর্মসূচি – তৃতীয় ধাপ প্রকল্প এ ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই সহায়তা দিচ্ছে, তবে অর্থায়ন আরও বাড়ানো উচিত।
৪. জাহাজ মালিক, ক্যাশ বায়ার ও শিল্প সংগঠনগুলোর অংশগ্রহণে একটি তহবিল গঠন করা দরকার, যাতে আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে জাহাজ ভাঙা সম্ভব হয়।
দায় এড়ানোর বিতর্ক সময় নষ্ট ছাড়া কিছুই নয়। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এখন প্রয়োজন কার্যকর প্রশাসনিক সক্ষমতা, বিনিয়োগ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। সময়মতো হংকং আন্তর্জাতিক কনভেনশন বাস্তবায়ন করলে শ্রমিকদের জীবন রক্ষা পাবে, পরিবেশ সুরক্ষিত হবে এবং বাংলাদেশ বৈশ্বিক জাহাজ ভাঙা শিল্পে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকবে।