দেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রভাবে ব্যাংকের ঋণ বিতরণ ও আদায় কার্যক্রমে বড় ধাক্কা লেগেছে। এর প্রভাবে সামগ্রিক অর্থনীতি ও ব্যাংকিং খাতের আর্থিক কাঠামো ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জন্য বিশেষ নীতিসহায়তা ঘোষণা করেছে সরকার। অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, উদ্যোগটি ইতিবাচক। সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলে ব্যবসা-বাণিজ্য আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। তবে একইসঙ্গে নীতির অপব্যবহার রোধে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
নীতিসহায়তার সুবিধা
ঘোষিত নীতিসহায়তায় মাত্র দুই শতাংশ ঋণ পরিশোধ করলেই খেলাপি ঋণ ১০ বছরের জন্য নিয়মিত করার সুযোগ দেওয়া হবে।
- যেসব প্রতিষ্ঠান বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন, ডলার সংকট বা রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারা এ সুবিধা পাবে।
- অতীতে পুনঃতফসিলীকরণ বা পুনর্গঠনের সুযোগ পাননি—এমন ব্যবসায়ীরাও অগ্রাধিকার পাবেন।
- যে কোনো পরিমাণ খেলাপি ঋণ পুনর্গঠন করা যাবে। তবে ৩০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ পুনর্গঠনে ব্যাংক নিজে সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে, তা পাঠাতে হবে নীতিসহায়তা সংক্রান্ত বাছাই কমিটির কাছে।
বিশেষজ্ঞদের সতর্কতা
ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, নীতিটি সৎ উদ্দেশ্যে নেওয়া হলেও এর প্রয়োগে সতর্ক না হলে অপব্যবহার ঘটতে পারে। অতীতে একই ধরনের সুবিধা নিয়ে প্রভাবশালীরা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে পাচার করেছেন। ফলে নতুন নীতিতে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তারা সুবিধা পাবেন কিনা, তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
বিকেএমইএ’র সাবেক সভাপতি মো. ফজলুল হক বলেন, “অনেক ব্যবসায়ী আন্দোলন ও অস্থিরতার কারণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এই সার্কুলার সঠিকভাবে প্রয়োগ করা গেলে তারা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন।” তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, “ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা আবারও সুবিধা নিতে চাইবে। তারা সুযোগ পেলে টাকা তুলে আবার পাচার করবে। তাই তাদের বাদ দিয়ে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের সহায়তা দিতে হবে।”
বিজিএপিএমইএ’র সভাপতি মো. শাহরিয়ার বলেন, “যারা টাকা নিয়ে পালিয়েছে, তারা যেন কোনোভাবেই এ সুবিধা না পায়। ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা সুবিধা পেলে সৎ ব্যবসায়ীদের ওপর বাড়তি চাপ পড়বে।”
দেশের রপ্তানি আয়ের ৮৫ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক শিল্প থেকে। এই খাতের অনেক কারখানা রাজনৈতিক আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল মনে করেন, সরকারের এই উদ্যোগ পোশাক খাতের অনেক প্রতিষ্ঠানকে টিকে থাকার সুযোগ দেবে।
তবে সবাই আশাবাদী নন। বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “২০১৬ সালের পর কয়েক দফায় এ ধরনের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ২০২২ সালে মাস্টার সার্কুলার দিয়েও একই সুযোগ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তখন খেলাপি ঋণ কমেনি, বরং বেড়েছে। এবারও সেই পুনরাবৃত্তি ঘটবে।”
সরকারের নীতিসহায়তা ব্যবসায়ী সমাজে স্বস্তি আনলেও ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের সুযোগ দিলে তা ব্যাংক খাতের জন্য নতুন বিপদ ডেকে আনতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উদ্যোগটি ভালো, তবে প্রয়োগে কঠোরতা না থাকলে এর ফলাফল হবে নেতিবাচক।

