১৯২৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের আড়ুয়াকান্দিতে জন্ম হয়েছিল এক ক্ষণজন্মা পুরুষের। তিনি স্যামসন এইচ. চৌধুরী—একটি নাম, যা সাহস, সততা আর মানবসেবার প্রতীক হয়ে আছে আজও। তার স্বপ্ন ও অদম্য ইচ্ছাশক্তি থেকে গড়ে ওঠে একটি শিল্প সাম্রাজ্য—স্কয়ার গ্রুপ।
শৈশবে বাবার মতো ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছে ছিল তার কিন্তু সংসারের টানাপোড়েন এবং ছোট ভাইবোনদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে মাত্র ১৭ বছর বয়সে স্বপ্ন ছেড়ে দেন। যোগ দেন রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভিতে। প্রচলিত সিগনালিং শাখায় না গিয়ে রাডার অপারেটর হতে চাওয়ায় তাকে চার দিন জেল খাটতে হয়েছিল কিন্তু তার দৃঢ়তার কাছে শেষ পর্যন্ত নেভি কর্তৃপক্ষ হার মানে। এখানেই প্রকাশ পায় তার অটল মানসিকতা।
যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে তিনি পাবনার ডাক বিভাগে চাকরি নেন। তবে উদ্যোক্তা মন থিতু হয়নি সেখানে। ১৯৫৬ সালে বাবার পরামর্শে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা মূলধন নিয়ে বাড়িতেই ছোট একটি ওষুধের কারখানা শুরু করেন। নাম দেন ‘ইসনস্’। স্ত্রী অনিতা চৌধুরী ছিলেন তার একমাত্র সহযোগী।
এরপর ১৯৫৮ সালে আরও তিন বন্ধুকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘স্কয়ার’। নামের মধ্যে ছিল প্রতীকী তাৎপর্য—চার বাহু মানে চার বন্ধু, আর স্কয়ার মানে শুদ্ধতা ও পূর্ণতা। তার মূল বিশ্বাস ছিল, সাফল্যের পথে শর্টকাট নেই। প্রথম তিন বছর কোনো লাভ হয়নি। কিন্তু নিরলস পরিশ্রমে ১৯৮৫ সালে স্কয়ার দেশের সব বহুজাতিক কোম্পানিকে পেছনে ফেলে শীর্ষে ওঠে। সেই অবস্থান আজও অটুট। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও স্কয়ারের ওষুধ ও নানা পণ্য পৌঁছে গেছে। ঔষধশিল্পের সাফল্যের পর তিনি ব্যবসা সম্প্রসারণে মন দেন। একের পর এক নতুন উদ্যোগে শিল্পখাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন।
- ১৯৮৮ সালে স্কয়ার টয়লেট্রিজ
- ১৯৯৪ সালে স্কয়ার টেক্সটাইলস
- ১৯৯৭ সালে মিডিয়াকম লিমিটেড
- ১৯৯৮ সালে এগ্রো-কেমিক্যালস ও ভেটেরিনারি প্রোডাক্টস
- ২০০০ সালে স্কয়ার স্পিনিং
- ২০০১ সালে স্কয়ার নিট ফ্যাব্রিক্স, ফ্যাশনস, কনজিউমার প্রোডাক্টস, ইনফরম্যাটিক্স ও স্কয়ার হসপিটালস
- ২০১১ সালে মাছরাঙা টেলিভিশন
সফল শিল্পপতি হয়েও তিনি ছিলেন মানবিক। সমাজসেবায় মুক্তহস্তে দান করেছেন। মানুষের সেবা করাকে তিনি জীবনের লক্ষ্য হিসেবে নিয়েছিলেন। ব্যবসাকে তিনি শুধু মুনাফার উৎস মনে করেননি, দেখেছেন সমাজকল্যাণের হাতিয়ার হিসেবে। তার সবচেয়ে বড় অর্জন হলো উত্তরসূরিদের মধ্যে নিজের দর্শন ও মূল্যবোধ পৌঁছে দিতে পারা। আজ তার সন্তানদের নেতৃত্বে স্কয়ার গ্রুপ শুধু ঔষধশিল্প নয়, বহুখাতে শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে। বিশেষ করে স্কয়ার হসপিটালস মানবসেবার আদর্শকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে।
২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি, ৮৬ বছর বয়সে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুতে শোক নেমে আসে সর্বস্তরে। রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, বিশিষ্টজন সবাই তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানান। ৭ জানুয়ারি তাকে পাবনায় চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। আজও তার রেখে যাওয়া আদর্শ ও মূল্যবোধের আলোকে এগিয়ে চলেছে স্কয়ার পরিবারের ৮১ হাজার সদস্য। প্রমাণ করছে, স্যামসন এইচ. চৌধুরী তার কাজের মধ্য দিয়েই বেঁচে আছেন মানুষের হৃদয়ে।

