বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে গতি আনতে সরকার এবার মেগা প্রকল্প পরিচালকদের (পিডি) জন্য বাড়তি বেতন ও বিশেষ আর্থিক প্রণোদনা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। এতে তাদের সুবিধা বিদেশি অর্থায়নের প্রকল্প পরিচালকদের কাছাকাছি হবে।
লক্ষ্য হচ্ছে যোগ্য ও সৎ কর্মকর্তাদের বড় প্রকল্প পরিচালনায় উৎসাহিত করা। কারণ প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং হলেও আর্থিক সুবিধা এখন তুলনামূলকভাবে কম। গতকাল পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগে আয়োজিত ২০২৪-২৫ অর্থবছর এবং চলতি অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা বিষয়ক এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় এই নির্দেশনা দেওয়া হয়। পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সভাপতিত্বে শেরে বাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রস্তাব আসে যোগ্য প্রকল্প পরিচালকের একটি পুল তৈরি করার—যেখানে কর্মকর্তাদের পরিকল্পনা, অর্থায়ন ও ক্রয় ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে, যাতে সেখান থেকে দক্ষতা বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়া যায়।
প্রস্তাবিত সুবিধার মধ্যে রয়েছে বাড়তি বেতন, পারফরম্যান্স বোনাস, বিভিন্ন ভাতা, পদায়ন ও রিটেনশন সুবিধা। এগুলো সব প্রকল্প পরিচালকের জন্য প্রযোজ্য হবে। পরিকল্পনা কমিশনের তথ্যানুযায়ী, এডিপি বাস্তবায়নে বড় ধস নেমেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাস্তবায়নের হার দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬৭.৮৫ শতাংশে, যা গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। প্রোগ্রামিং বিভাগের প্রধান মুসরাত মেহ্ জাবীন জানান, চলতি অর্থবছরের (২০২৬) প্রথম দুই মাসে বাস্তবায়নের হার মাত্র ২.৩৯ শতাংশ। গত বছরের একই সময়েও এ হার কিছুটা বেশি ছিল।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “অনেক সৎ কর্মকর্তা বাড়তি ঝামেলার কারণে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব নিতে চান না। কারণ এর জন্য কোনো বাড়তি আর্থিক সুবিধা নেই। কিন্তু যারা অনৈতিক সুবিধা নিতে চান, তারাই এগিয়ে আসেন।” তিনি আরও জানান, যে সব ঠিকাদার গত সরকারের পতনের পর ফিরে আসেননি, তাদের বাদ দিয়ে দ্রুত পুনর্নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু প্রণোদনা বাড়ালেই হবে না। জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সমান জরুরি। আইএনএম-এর নির্বাহী পরিচালক মুস্তাফা কে মুজেরী বলেন, “অতিরিক্ত সুবিধা দিলেই দুর্নীতি কমবে—এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। বরং সুযোগ থাকলে দুর্নীতি চলতেই পারে। তাই সুবিধা বৃদ্ধির পাশাপাশি দুর্নীতি দমনে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।” টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বাড়তি সুবিধা দিলে দুর্নীতি কমবে না, বরং বেড়ে যেতে পারে। ভালো কাজের স্বীকৃতি প্রকল্প শেষে পুরস্কার আকারে দেওয়া উচিত।” সাবেক পরিকল্পনা সচিব মো. মামুন-আল-রশিদও একই মত দেন। তিনি বলেন, কাস্টমস ও কর কর্মকর্তাদের বিশেষ প্রণোদনা দিয়েও দুর্নীতি কমানো যায়নি। রাজস্ব খাতে দুর্নীতি আগের মতোই চলছে। সভায় আরও আলোচনা হয়—
- প্রকল্প পরিচালকদের পরিকল্পনা, সরকারি অর্থব্যবস্থাপনা ও সরকারি ক্রয়বিধি-২০০৮ বিষয়ে সার্টিফিকেশন কোর্স চালুর প্রস্তাব
- কর্মদক্ষতার ভিত্তিতে পুরস্কৃত করার সুপারিশ
- নিয়োগ ও বদলির জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন
- ভূমি অধিগ্রহণ ও ইউটিলিটি স্থানান্তরের জন্য পৃথক প্রকল্প আগে বাস্তবায়নের সুপারিশ
পরিকল্পনা উপদেষ্টা উদাহরণ টেনে বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পে প্রায়ই ডাক্তারদের প্রকল্প পরিচালক করা হয়। তাদের আর্থিক ব্যবস্থাপনা বা প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা না থাকায় প্রকল্পে ব্যর্থতা দেখা দেয়। ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ভূমি অধিগ্রহণে দুই মাস সময় লাগার কথা বলা হলেও বাস্তবে অনেক সময় আট-দশ বছর লেগে যায়। এতে খরচ বেড়ে যায় এবং প্রকল্পের কাজ বিলম্বিত হয়। এজন্য ভবিষ্যতে আগে ভূমি অধিগ্রহণ শেষ করে মূল প্রকল্প শুরু করা হবে।
তিনি জানান, অতীতের টেন্ডার প্রক্রিয়া দুর্বল ছিল। বাতিল হওয়া ঠিকাদাররা আবারও বেনামে কাজ পেত। তবে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে ক্রয় বিধিমালা-২৫ অনুমোদন হবে। আর সরকারি ক্রয় নীতিমালা (পিপিআর-২০২৫) গেজেট হলে দরপত্র প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ ও প্রতিযোগিতামূলক হবে। পরিকল্পনা উপদেষ্টা স্বীকার করেন, সচিব বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষণে দুর্বলতা রয়েছে। এতে প্রকল্পে বারবার সংশোধন আনতে হয় এবং সময়ও বেড়ে যায়। সভায় প্রস্তাব আসে—
- সংস্থা পর্যায়ে দক্ষ জনবল বাড়ানো
- ডিপিপি প্রণয়নে বরাদ্দ নিশ্চিত করা
- প্রকল্পে শুরু থেকেই ফোকাল পার্সন নিয়োগ
- সম্ভাব্যতা সমীক্ষা মানোন্নয়নে স্বাধীন বিশেষজ্ঞ দ্বারা পিয়ার রিভিউ বাধ্যতামূলক করা
- বাজার জরিপ, চাহিদা পূর্বাভাস, ঝুঁকি বিশ্লেষণ ও সামাজিক প্রভাব মূল্যায়ন যুক্ত করা
এছাড়া বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)-এর কার্যালয় স্থাপনের প্রস্তাবও করা হয়। মুস্তাফা কে মুজেরী বলেন, দক্ষতা যাচাইয়ের জন্য স্বচ্ছ মানদণ্ড তৈরি জরুরি। না হলে অযোগ্য বা দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা নিজেদের দক্ষ হিসেবে প্রমাণ করে সিস্টেমকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। টিআইবি নির্বাহী পরিচালকও সতর্ক করে বলেন, প্রকল্প পরিচালকের পদকে যেন ব্যক্তিগত লাভের হাতিয়ার না বানানো হয়।