বাংলাদেশের চামড়া খাত আবারও আশার আলো দেখাচ্ছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ অর্থবছরে চামড়া, চামড়াজাত পণ্য ও জুতা রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল প্রায় ১ হাজার ১৪৫ মিলিয়ন ডলার। ২০২৫ অর্থবছরের জুন পর্যন্ত এ আয় দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ হাজার ৩৯ মিলিয়ন ডলারে। শুধু চামড়ার জুতা থেকেই আয় হয়েছিল ২০২৪ অর্থবছরে ৬৭২ মিলিয়ন ডলার, যা চলতি অর্থবছরের জুন পর্যন্ত নেমে এসেছে ৫৪৪ মিলিয়ন ডলারে।
তবে এই খাতে উত্থান সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ছে জুতা শিল্পে। বিশেষ করে নন-লেদার জুতা রপ্তানি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দ্রুত বেড়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম জুতা উৎপাদনকারী দেশ। গত অর্থবছরে চামড়াজাত পণ্য ও জুতা রপ্তানি মিলিয়ে আয় হয়েছিল প্রায় ১.৬ বিলিয়ন ডলার, যা বাজারে শক্ত চাহিদা ও উৎপাদন সক্ষমতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই খাত প্রায় ৮ থেকে ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান করছে বলে সরকারি ও বেসরকারি পর্যালোচনায় জানা গেছে। ফলে এ শিল্প দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখছে।
সাফল্যের পাশাপাশি বড় চ্যালেঞ্জও রয়েছে। সাভারের ট্যানারি শিল্পনগরীর সেন্ট্রাল ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (সিইটিপি) দীর্ঘদিন ধরে মানসম্মতভাবে পরিচালিত হচ্ছে না। ফলে পরিবেশগত মানদণ্ডে ব্যর্থ হওয়ায় অনেক ট্যানারি ক্রেতাদের শর্ত পূরণ করতে পারছে না। এতে উচ্চমূল্যের অর্ডার হারানোর ঝুঁকি বাড়ছে। এ ছাড়া দেশীয় সরবরাহ শৃঙ্খল দুর্বল, সিনথেটিক কাঁচামাল স্বল্পতা, কাস্টমসে ধীরগতি এবং আধুনিক উৎপাদন লাইনের জন্য প্রশিক্ষিত জনবল ঘাটতি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছোট কারখানাগুলো তহবিলের অভাবে প্রযুক্তি উন্নয়নে পিছিয়ে রয়েছে। এসব কারণে উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে ও সময়মতো সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে।
এই মুহূর্তে খাতটিকে টিকিয়ে রাখছে জুতা শিল্প। বিশেষ করে নন-লেদার জুতা রপ্তানি এ বছর অর্ধ বিলিয়ন ডলার ছাড়ানোর পথে। আধুনিক যন্ত্রপাতি ও নতুন নকশায় বিনিয়োগের ফলে কারখানাগুলো এখন উন্নত মানের জুতা তৈরি করছে। ছোট কর্মশালাগুলোও আন্তর্জাতিক মান পূরণে সক্ষম হয়েছে। এতে কাটার, সেলাই ও প্যাকেজিংয়ের কাজে নিয়মিত কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে। পণ্যের মান উন্নত হওয়ায় দামও বেশি পাওয়া যাচ্ছে এবং পুরোনো ক্রেতাদের কাছ থেকে নতুন অর্ডার আসছে। পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, সহজ ঋণ ও বাজারে প্রবেশাধিকারের সহায়তা পেলে এই সাফল্য আরও বিস্তৃত হতে পারে।
আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেতে লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজির) সার্টিফিকেশন গুরুত্বপূর্ণ। এ সংস্থা ট্যানারির পানি ব্যবহার, শক্তি খরচ, রাসায়নিক নিরাপত্তা ও বর্জ্য শোধনের মান যাচাই করে। সার্টিফায়েড চামড়া সহজেই বড় ক্রেতাদের কাছে বিক্রি হয় কিন্তু বাংলাদেশের অনেক ট্যানারি এখনো এলডব্লিউজির সার্টিফিকেশন পায়নি। মূল সমস্যা হচ্ছে সিইটিপির দুর্বলতা ও প্রয়োজনীয় টেকনিক্যাল ডকুমেন্টেশনের ঘাটতি। ছোট ইউনিটগুলো এসব শর্ত মেনে চলতে হিমশিম খাচ্ছে। ফলে অনেক ক্রেতা পিছিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া ক্ষুদ্র কর্মশালাগুলোতে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ আছে। এতে খাতের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাভারের সিইটিপি কার্যকরভাবে চালু হলে ট্যানারিগুলো পরিবেশগত শর্ত পূরণ করতে পারবে এবং ক্রেতাদের আস্থা ফিরে আসবে। পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে বর্জ্য শোধনাগার স্থাপন করলে চাপ কমবে। ছোট ইউনিটগুলোকে স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ, স্বল্পসুদে ঋণ ও ধাপে ধাপে প্রণোদনা দিলে তারা প্রযুক্তি উন্নয়ন ও সার্টিফিকেশনের পথে এগোতে পারবে। এতে পরিবেশসম্মত উৎপাদন খাতের জন্য বোঝা না হয়ে বরং বিক্রির সুযোগ হয়ে উঠবে।
অন্যদিকে, দ্রুত কাস্টমস প্রক্রিয়া ও সহজ গুদাম নীতিমালা সরবরাহ সময় কমাতে সাহায্য করবে। স্থানীয়ভাবে সিনথেটিক উপকরণ সরবরাহ বাড়লে উৎপাদন আরও মসৃণ হবে। সব মিলিয়ে শক্তিশালী বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেশন, দক্ষ জনবল ও সরবরাহ শৃঙ্খল উন্নয়ন হলে বাংলাদেশ এই খাত থেকে আরও বেশি রপ্তানি আয় করতে পারবে।