উপমহাদেশে ব্রিটিশ উপনিবেশ যুগে ব্যবসার সুবিধার্থে কোম্পানির মাধ্যমে শাসনব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। তখন রাষ্ট্র পরিচালনার মূল লক্ষ্য ছিল মুনাফা অর্জন, আর সাধারণ মানুষের স্বার্থ প্রায়শই উপেক্ষিত হতো। স্বাধীনতার পরও এই পুরনো নীতিমালা ও আইন অনেকাংশে বেঁচে গেছে, বিশেষ করে বাজারে মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে।
বর্তমানে কিছু খাদ্যপণ্যের দাম সরকার নির্ধারণ করলেও অধিকাংশ বাণিজ্যিক পণ্যের ক্ষেত্রে কোনো নির্ভরযোগ্য ব্যয়ভিত্তিক মূল্য নির্ধারণ নেই। ফলে বাজারে পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য, অতিরিক্ত মুনাফা ও ভোক্তার শোষণ একটি সাধারণ চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভোক্তার অধিকার ও আইনের শূন্যতা
ভোক্তার অধিকার আইন ২০০৯-এর অধীনে মৌলিক অধিকারগুলোতে উল্লেখ আছে ন্যায্য মূল্য, সঠিক পরিমাপ, পণ্যের গুণগত মান ও নকল না হওয়া। তবে “ন্যায্য মূল্য” সম্পর্কে সুস্পষ্ট সংজ্ঞা বা নির্দেশনা নেই। ফলে মুক্ত বাজারের নামে চলছে অতিরিক্ত মুনাফার প্রতিযোগিতা ও সিন্ডিকেট বাণিজ্য, যা বাজারকে অস্থিতিশীল করছে।
চাকরিজীবীরা বাজারে গিয়ে দাম নিয়ে প্রশ্ন তুললেও আইনের সীমাবদ্ধতার কারণে বড় কোম্পানিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। সাধারণত ছোট ব্যবসায়ীদের উপর নজরদারি চলে, বড় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায়ই নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে।
উৎপাদন ব্যয়: ন্যায্য মূল্যের ভিত্তি
ন্যায্য মূল্য নির্ধারণে শুধু কাঁচামালের দাম নয়, ওভারহেড খরচ, অপচয়, উৎপাদন দক্ষতা এবং উৎপাদনের পরিমাণের পরিবর্তনসহ পুরো উৎপাদন ব্যয়ের সঠিক হিসাব অপরিহার্য। সঠিক তথ্য ও সুষম বণ্টন ছাড়া ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ সম্ভব নয়।
প্রস্তাবনা: আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার
দেশীয় বাজারে খাদ্য, পণ্য ও ঔষধ বিক্রয়ে ভোক্তার ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তাব করা হচ্ছে:
১. ন্যায্য মূল্যের সংজ্ঞা নির্ধারণ: নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মূল্য নির্ধারণ, স্বাধীন পেশাজীবী (সিএমএ) প্রত্যায়ন বাধ্যতামূলককরণ এবং অনুমোদিত মূল্য পরিবর্তনের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ।
২. জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ক্ষমতা:
-
খাদ্যপণ্য: সরকারি নিয়ন্ত্রণিত পণ্য ব্যতীত সব খাদ্যপণ্যের দাম অধিদপ্তর নির্ধারণ করবে। আমদানিকৃত পণ্যের দাম সিএমএ প্রত্যায়নের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
-
পণ্য: ব্র্যান্ড বা মোড়কযুক্ত পণ্যের দাম সিএমএ প্রত্যায়নের ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে।
-
ঔষধ: ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের নির্দেশনার আলোকে সিএমএ প্রত্যায়নের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দাম নির্ধারণ করা হবে।
৩. ন্যায্য মূল্যের ব্যাখ্যা: কোম্পানি আইন ১৯৯৪-এর ধারা ২২০ অনুযায়ী, স্বাধীন নিরীক্ষক কর্তৃক প্রত্যায়িত মূল্য বা সরকার নির্ধারিত মূল্যকে ন্যায্য মূল্য ধরা হবে।
সিএমএ অন্তর্ভুক্তির প্রয়োজনীয়তা
আইসিএমএবি পেশাজীবীদের অন্তর্ভুক্তি বাজারে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে অপরিহার্য। উৎপাদন ব্যয় বিশ্লেষণ, কাঁচামালের ব্যবহার, অপচয় ও ওভারহেডের সঠিক হিসাব, উৎপাদন কার্যক্রমের মান যাচাই—সবকিছুতে সিএমএ পেশাজীবীদের দক্ষতা বাজারে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
লাভজনক প্রভাব:
-
ভোক্তা ন্যায্য মূল্যে পণ্য পাবেন।
-
অতিরিক্ত মুনাফা ও ফটকা বাজার নিয়ন্ত্রণ হবে।
-
সরকার ও জনগণের মধ্যে বিশ্বাস গড়ে উঠবে।
-
একাধিক পণ্যের ক্ষেত্রে মুনাফা সুষমভাবে বিতরণ হবে।
-
খাদ্যপণ্যের গুণগত মান ও মূল্যের সামঞ্জস্য নিশ্চিত হবে।
-
সংস্থার কমপ্লায়েন্স বাস্তবায়নের সমন্বয় সাধিত হবে।
ভারতে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দাম নির্ধারণে সিএমএ পেশাজীবীদের অন্তর্ভুক্তি বিদ্যমান। এটি স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা এবং জনগণের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ।
চিফ ফিনান্সিয়াল অফিসার, কোহিনুর কেমিক্যাল কোং (বিডি) লি-এর মতে, বাজারে ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা শুধু নিয়ন্ত্রণ নয়, এটি সামাজিক ন্যায় ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার কার্যকর হাতিয়ার। জনস্বার্থে আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার আনা এবং সিএমএ পেশাজীবীদের অন্তর্ভুক্তি অপরিহার্য।