দেশের শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের মধ্যে অন্যতম আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক। তিন দশক আগে প্রতিষ্ঠিত এই ব্যাংকের নেতৃত্বে পরিবর্তন আসে গত আগস্টে সরকার বদলের পর। বর্তমানে এক বছরের বেশি সময় ধরে ব্যাংকটি পরিচালনা করছেন স্বতন্ত্র পরিচালকরা। ব্যাংকটির সার্বিক অবস্থা, বিনিয়োগ কৌশল ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) রাফাত উল্লা খান।
প্রশ্ন : তিন দশকে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক কতটা বড় হয়েছে? কোন খাতে কেমন বিনিয়োগ করছেন?
রাফাত উল্লা খান: আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক ১৯৯৫ সালে যাত্রা শুরু করেছিল একদল অগ্রণী উদ্যোক্তার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার মাধ্যমে। তখনই ব্যাংকটির লক্ষ্য ছিল একটি স্বচ্ছ, সুদমুক্ত ও সম্পূর্ণ শরিয়াহসম্মত ব্যাংকিং ব্যবস্থা দাঁড় করানো। শুরুতে ব্যাংকটি মাত্র কয়েকটি শাখা দিয়ে কার্যক্রম শুরু করলেও ৩০ বছরের ধারাবাহিক পরিশ্রম, অঙ্গীকার ও সঠিক কৌশলের মাধ্যমে আজ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত। তিন দশকে ৪০ লাখ গ্রাহকের প্রায় সাড়ে ৫৪ হাজার কোটি টাকার আমানত রয়েছে এই ব্যাংকে। বর্তমানে আমাদের শাখার সংখ্যা ২২৬, উপশাখা ৮৯ ও এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট ৭৫০টি। এ ছাড়া ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এআইবি আই-ব্যাংকিং ও ইসলামিক ওয়ালেটের মাধ্যমে গ্রাহকেরা এখন যেকোনো স্থানে বসেই লেনদেন করতে পারছেন।
বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক সব সময় উৎপাদনশীল খাতকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। বর্তমানে ব্যাংকের মোট বিনিয়োগ ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি। কৃষি খাতে আমদের বর্তমান বিনিয়োগ ৮২৫ কোটি টাকা। শিল্প ও নির্মাণ খাতে ৩৫ হাজার ৯৬০ কোটি টাকার বেশি। তৈরি পোশাক শিল্প, চামড়া, তথ্যপ্রযুক্তি—এসব খাতেই আমাদের বিনিয়োগ বেশি। পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা (এসএমই) খাতেও বিনিয়োগ ধীরে ধীরে বাড়ছে। সাম্প্রতিক সময়ে অবকাঠামো উন্নয়ন ও রিটেইল ব্যাংকিং খাতেও বিনিয়োগে ভালো প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। সব মিলিয়ে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের এখন একটি বহুমুখী, বৈচিত্র্যময় ও স্থিতিশীল ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়ে আছে।
রাফাত উল্লা খান: ইসলামী ব্যাংকিংয়ের মূল দর্শন হলো একটি সুদবিহীন আর্থিক ব্যবস্থা। প্রচলিত ধারার ব্যাংক ঋণের বিপরীতে নির্দিষ্ট সুদ ধার্য করে এবং ঝুঁকির দায় প্রায়ই গ্রাহকের ওপর থাকে। সেখানে ইসলামী ব্যাংক শরিয়াহসম্মত চুক্তির মাধ্যমে গ্রাহকের সঙ্গে অংশীদারি স্থাপন করে। এই অংশীদারির মাধ্যমে লাভ ও ক্ষতি দুই পক্ষের মধ্যে ন্যায্যভাবে ভাগ হয়, যা প্রকৃত অর্থে ঝুঁকির সুষম বণ্টন নিশ্চিত করে। আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক মুদারাবা, মুশারাকা, ইজারা, মুরাবাহা, বাই-মুআজ্জালসহ বিভিন্ন শরিয়াহসম্মত চুক্তির মাধ্যমে লেনদেন পরিচালনা করে। প্রতিটি পণ্য ও সেবার কার্যক্রম ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডের মাধ্যমে অনুমোদিত এবং নিয়মিত পর্যালোচনা করা হয়। আমরা নিয়মিত শরিয়াহ নিরীক্ষা এবং অভ্যন্তরীণ পর্যালোচনা করে থাকি, যাতে প্রতিটি পদক্ষেপ, চুক্তি ও লেনদেন শরিয়াহ নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে।
রাফাত উল্লা খান: অনিয়ম বা সুশাসনের ঘাটতি কোনো একধরনের ব্যাংক বা খাতের সমস্যা নয়, এটি পুরো ব্যাংকিং খাতের চ্যালেঞ্জ। তবে ইসলামী ব্যাংকের সংখ্যা ও আকার বড় হওয়ায় যেকোনো সমস্যা দ্রুত দৃষ্টিগোচর হয় এবং বেশি গুরুত্ব পায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু ইসলামী ব্যাংকে ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার ক্ষেত্রে সংকট দেখা গেছে, যা গ্রাহক ও আমানতকারীর আস্থা নষ্ট করেছে। তবে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক শুরু থেকেই স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সুশাসনের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। আমরা আমাদের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করেছি এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করেছি, যাতে প্রতিটি বিনিয়োগ ও লেনদেন নিরাপদ ও ফলপ্রসূ হয়। একই সঙ্গে আমরা দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলেছি, যাঁরা শরিয়াহ নীতি মেনে দায়িত্ব পালন করছেন এবং ব্যাংকের নীতি, নিয়ম ও মানদণ্ডের প্রতি দায়বদ্ধ। আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক সব সময় নীতি, নিয়ম ও শরিয়াহ নির্দেশনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরিচালিত হয়েছে। ভবিষ্যতেও এই ধারা অব্যাহত থাকবে।
রাফাত উল্লা খান: রাজনৈতিক অস্থিরতা বা পরিবর্তন ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে আমাদের ব্যাংকের গ্রাহকভিত্তি বৈচিত্র্যময় হওয়ায় আমরা তুলনামূলক ভালোভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছি। আমাদের নীতি স্পষ্ট—গ্রাহককে বিপদে ফেলে ব্যাংকের উন্নতি সম্ভব নয়। তাই আমরা তাঁদের সঙ্গে অংশীদার হিসেবে কাজ করছি, সমাধান খুঁজে বের করছি। নতুন ও উদ্ভাবনী সেবা নিয়ে গ্রাহক সমস্যার সমাধানে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। দায়িত্ব গ্রহণের পর আমার প্রথম লক্ষ্য ছিল আস্থা পুনর্গঠন।
আমানতকারী, গ্রাহক ও শেয়ারধারী—সবাইকে আশ্বস্ত করতে হয়েছে, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক একটি শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এই লক্ষ্য অর্জনে আমরা একদিকে সেন্ট্রালাইজড অ্যাপ্রোচ গ্রহণ করেছি, যাতে নীতি ও কৌশলগত সিদ্ধান্তগুলো কেন্দ্রীয়ভাবে সুনির্দিষ্ট ও সমন্বিতভাবে বাস্তবায়িত হয়। অন্যদিকে সেগমেন্টেড অ্যাপ্রোচ চালু করেছি, যাতে প্রতিটি গ্রাহক গোষ্ঠী—রিটেইল, এসএমই, করপোরেট ও কৃষি খাত—তাদের নিজস্ব চাহিদা অনুযায়ী সেবা পেতে পারে। ফলে ব্যাংকিং কার্যক্রম আরও গতিশীল, সহজপ্রাপ্য ও গ্রাহকবান্ধব হয়েছে। আমাদের কৌশল একেবারেই স্পষ্ট—শরিয়াহ মানদণ্ড মেনে আধুনিক ব্যাংকিং সেবা দেওয়া। আমরা চাই, দীর্ঘ মেয়াদে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক শুধু দেশের নয়, ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হোক। সূত্র: প্রথম আলো