বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল খাত দেশের সর্বোচ্চ রপ্তানি আয় এবং কর্মসংস্থানের উৎস। তবে এগুলো ব্যাংকিং খাতের সর্ববৃহৎ ঋণ খেলাপিদের মধ্যেও রয়েছে। এটি উঠে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংক এর সর্বশেষ ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্টে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালে তৈরি পোশাক খাতে মোট ঋণের ২৬ শতাংশ খেলাপি হয়েছে। টেক্সটাইল খাতে এই হার ২৫ শতাংশ। এর চেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে শুধু জাহাজ নির্মাণ ও চামড়া শিল্প, যেখানে খেলাপি ঋণের হার ৩৯ শতাংশ। খেলাপি ঋণের হার বোঝায় মোট বকেয়া ঋণের কত অংশ ফেরত আসেনি। যেমন চামড়া শিল্পে প্রতি ১০০ টাকার ঋণের মধ্যে ৩৯ টাকাই অনাদায়ী। অন্যান্য খাতের চিত্রও উদ্বেগজনক—নির্মাণ খাতের খেলাপি ঋণ ২৪ শতাংশ, পরিবহন খাতে ২০ শতাংশ, কৃষিভিত্তিক শিল্পে ১৪ শতাংশ। তুলনামূলকভাবে ভালো করেছে ওষুধ শিল্প (৬%), কৃষি খাত (১১%) এবং আবাসন খাত (১২%)।
ঋণ পরিশোধে সমস্যা থাকলেও পোশাক শিল্প দেশের অর্থনীতিতে প্রধান ভরসা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই খাত রপ্তানি করেছে ৩৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি, যা মোট রপ্তানির ৮৪ শতাংশ। একই সঙ্গে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ এই খাতে কর্মরত, যাদের বড় অংশ নারী। শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বড় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল থাকলেও ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো বেশি খেলাপির সমস্যায় পড়ছে।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজএর সভাপতি ও সাবেক বিজিএমইএ সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী বলেন, “বড় কোম্পানিগুলো ব্যাংক এবং লজিস্টিকসের সঙ্গে দরকষাকষির ক্ষমতা রাখে। তাই তারা বৈশ্বিক দামের ধাক্কা সামলাতে পারে। কিন্তু ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো বেশি খরচে পড়ে আর্থিক সংকটে পড়ে।”
ব্যাংকাররাও একই মত দিয়েছেন। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সাবেক বাংলাদেশ ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, মহামারির পর অনেক ছোট ও মাঝারি কারখানা আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে। দীর্ঘস্থায়ী জ্বালানি সংকটও পরিস্থিতি আরও খারাপ করেছে। আমরা এক কারখানাকে অর্থায়ন করেছিলাম। তারা টানা এক বছর বিদ্যুৎ সমস্যায় ভুগে শেষে খেলাপি ঋণগ্রহীতা হয়ে যায়। এ ধরনের ঘটনা এখন সাধারণ হয়ে গেছে।” পুঁজিবাজারেও এ খাতের সমস্যা প্রতিফলিত হচ্ছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ-এ তালিকাভুক্ত ৫৮টি টেক্সটাইল ও পোশাক কোম্পানির মধ্যে ২৫টি এখন জাঙ্ক স্টক, আর ১৭টি লো-পারফরম্যান্স বি-ক্যাটাগরিতে। মোটের ওপর খাতের ৭০ শতাংশের বেশি কোম্পানি লাভে নেই।
অর্থনীতিবিদ এবং পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশ এর চেয়ারম্যান এম মাসরুর রেজা বলেন, মহামারির পর বৈশ্বিক চাহিদা কমে যাওয়া এবং জ্বালানি সংকট টেক্সটাইল খাতকে বড় ধাক্কা দিয়েছে। অনেক মিল এখন অর্ধেক সক্ষমতায় চলছে। তিনি বলেন, “গত কয়েক বছরে প্রায় ৩০০ কোম্পানি আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে। বিজিএমইএ এখন তাদের জন্য এক্সিট পলিসি বিবেচনা করছে।” তিনি আরও জানান, জাহাজ নির্মাণ শিল্প বৈশ্বিক মন্দার কারণে দুর্বল, চামড়া শিল্প রপ্তানিতে মান অনুসরণের জটিলতায় সীমাবদ্ধ।
তিনি আরো সতর্ক করেছেন, এত উচ্চ খেলাপি ঋণ রপ্তানি খাতের জন্য বড় সতর্কবার্তা। তিনি বলেন, যদি প্রধান রপ্তানি খাতগুলো দীর্ঘদিন অচল থাকে, তবে দেশের রপ্তানি আয় ও কর্মসংস্থান উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।” তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন খাতভিত্তিক নীতি পুনর্বিবেচনা ও সমস্যাজনক প্রতিষ্ঠানের পুনর্গঠন পরিকল্পনা নিতে। এছাড়া টেকসই নয় এমন প্রতিষ্ঠানের জন্য পরিকল্পিত এক্সিট স্ট্র্যাটেজি গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন।