বাংলাদেশে সব মেয়াদের ট্রেজারি বিলের সুদের হার এখন এক অঙ্কের নিচে নেমে এসেছে। ব্যাংকিং খাতে লিকুইডিটি বৃদ্ধি এবং সরকারী ঋণ চাহিদা কমার ফলে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন মাসে ট্রেজারি বিলের সুদের হার ২১১ থেকে ২৩৩ বেসিস পয়েন্ট কমেছে। গতকালকের নিলামে ৯১ দিনের, ১৮২ দিনের এবং ৩৬৪ দিনের ট্রেজারি বিলের সুদ যথাক্রমে ৯.৯০%, ৯.৭৮% এবং ৯.৬৮% রেকর্ড করা হয়েছে। তুলনামূলকভাবে, জুলাইয়ে এই হার ছিল প্রায় ১২%।
ট্রেজারি বিল হলো এক বছরের কম মেয়াদের সরকারী সিকিউরিটি। এগুলোকে নিরাপদ ও কম ঝুঁকির বিনিয়োগ হিসেবে দেখা হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মূলত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বেশি করে ট্রেজারি বিল ক্রয় করছে, যেখানে তারা অতিরিক্ত লিকুইডিটি ব্যবহার করছে। মধ্য ২০২৩ থেকে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদের হার বেড়ে ১০% অতিক্রম করেছিল। তবে এই মাসে তা আবার কমতে শুরু করেছে। দীর্ঘমেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের সুদের হারও একই ধারা অনুসরণ করছে। ১০, ১৫ ও ২০ বছরের বন্ডের সুদের হার যথাক্রমে ৯.৮৮%, ৯.৬৬% ও ৯.৬৯%।
ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা দুইটি প্রধান কারণে সুদের হ্রাস ব্যাখ্যা করছেন। প্রথমত, জুলাই থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ১.৮৮ বিলিয়ন ডলার ক্রয় করেছে। এর ফলে বাজারে প্রায় ২৩,০০০ কোটি টাকা ঢুকেছে এবং লিকুইডিটি বাড়েছে। দ্বিতীয়ত, সরকার ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মাধ্যমে ঋণ নেওয়া কমিয়েছে, যার ফলে চাহিদা কমে সুদের হারও কমেছে।
এনআরবিসি ব্যাংকের এমডি ও সিইও মো. তৌহিদুল আলম খান বলেন, “ট্রেজারি বিলের সুদের হার এক অঙ্কের নিচে নেমে আসার মূল কারণ হলো বাংলাদেশ ব্যাংকের বাজার হস্তক্ষেপ। এছাড়া প্রাইভেট সেক্টরের ঋণ বৃদ্ধির কম গতি ও রেমিট্যান্স প্রবাহও এই হ্রাসে ভূমিকা রাখছে।”
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রাক্তন প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হুসাইন বলেন, “ডলার ক্রয় নিলামের মাধ্যমে বাজারে অর্থ সরবরাহ বেড়েছে। ফলে ট্রেজারি বিলের সুদের হার কমেছে।” প্রাইভেট সেক্টরে ঋণ বৃদ্ধি জুলাইয়ে মাত্র ৬.৫২% রেকর্ড করেছে। এই পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত তহবিল সরকারী সিকিউরিটিতে ব্যবহার করছে, যেখানে নিশ্চিত রিটার্ন পাওয়া যায়।
সিনিয়র ব্যাংক কর্মকর্তা ও অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদের হার কমলে ব্যাংকিং খাতে ডিপোজিট এবং ঋণ সুদেও প্রভাব পড়বে। বর্তমানে শীর্ষ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ডিপোজিটে ৮–৯% সুদ দিচ্ছে, অন্যরা ৭% বা তার কম সুদ দিচ্ছে। নিরাপদ সরকারী ঋণের খরচ কমার ফলে ব্যাংকগুলোও ডিপোজিটের সুদ কমাতে পারে। ঋণ সুদ বর্তমানে গড়ে ১৩% এর বেশি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এটি কমানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদের হারে পরিবর্তন প্রয়োজন। মো. তৌহিদুল আলম খান বলেন, “ট্রেজারি বিলের সুদের হার কমায় বাণিজ্যিক ব্যাংক ডিপোজিটে সুদ কমিয়েছে। এর প্রভাব ঋণের হারেও পড়বে, ফলে ঋণের খরচ কমবে।”
যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সুদের হার বর্তমানে ১০% রয়েছে। যদি এটি অপরিবর্তিত থাকে, তবে ডিপোজিটের হার কমলেও ব্যাংক স্প্রেড বেড়ে যেতে পারে। ব্যাংকাররা মনে করছেন, ঋণ সুদ কমানোর জন্য নীতি সুদের হার কমানো প্রয়োজন। এতে সস্তা ঋণ ও নতুন বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা থাকবে। জাহিদ হুসাইন সতর্ক করে বলেন, “ঋণ সুদ কমলে ঋণ নেওয়া বাড়তে পারে, তবে বর্তমান দুর্বল বিনিয়োগ পরিবেশে এটি নতুন বিনিয়োগ ত্বরান্বিত নাও করতে পারে।”