এক দশকের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে কিন্তু কেরানীগঞ্জের বুড়িগঙ্গা তীরে গড়ে ওঠা পানগাঁও ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো (আইসিডি) আজও পূর্ণ সক্ষমতায় কাজে লাগানো যায়নি। ২০১৩ সালের শেষে উদ্বোধনের সময় এই টার্মিনালকে চট্টগ্রাম বন্দরের জট কমানোর সমাধান হিসেবে দেখা হয়েছিল। প্রায় ১৫৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত দেশের প্রথম নদীনির্ভর এই টার্মিনাল বছরে ১ লাখ ১৬ হাজার টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডল করার সক্ষমতা নিয়ে চালু হয়।
কিন্তু এখন বাস্তবতা ভিন্ন। টার্মিনালটির ব্যবহার হচ্ছে সক্ষমতার ২০ শতাংশেরও কম, অনেক সময় তা নেমে আসে মাত্র ৫ শতাংশে। ফলে একে ব্যর্থ প্রকল্প বলেই আখ্যা দিচ্ছেন অনেকে। ২০২৩ সালে পানগাঁও আইসিডি ব্যবহার করে মাত্র ৩০ হাজার টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডল করা হয়েছে, যা সক্ষমতার চারভাগের একভাগ। ২০২৪ সালে মাসিক হ্যান্ডলিং নেমে আসে ৪ হাজার টিইইউএসের নিচে। ব্যবসায়ীদের মতে, এর মূল কারণ অতিরিক্ত খরচ।
চট্টগ্রাম থেকে পানগাঁও হয়ে পণ্য খালাস করতে প্রতি টিইইউএসে বাড়তি ৮০০ থেকে ১,০০০ ডলার বেশি খরচ হয়। এই খরচে মেইনলাইন অপারেটরের ভাড়া, স্থানীয় বার্জ অপারেটরের চার্জ এবং দুই বন্দরে লোডিং-আনলোডিংয়ের ফি অন্তর্ভুক্ত। ফলে রপ্তানিকারকেরা এই বন্দর ব্যবহার থেকে সরে গেছেন। একসময় সপ্তাহে তিনটি জাহাজ আসত, এখন মাসে তিনটিতে নেমে এসেছে।
বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, রপ্তানির ক্ষেত্রে বায়ারের অনুমতি ছাড়া বিল অব লেডিং দেওয়া যায় না। যেহেতু পানগাঁও থেকে নির্দিষ্ট শিডিউলে জাহাজ ছাড়ে না এবং খরচও বেশি, তাই বায়াররা এ বন্দরের মাধ্যমে চালান পাঠাতে রাজি হন না।
শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন বলেন, সড়ক বা রেলপথে আনা তুলনামূলকভাবে সস্তা ও দ্রুত। গাজীপুরের কারখানা থেকে পানগাঁওয়ে পণ্য এনে জাহাজে লোড করতে তিন থেকে চার দিন লাগে। অথচ রাতারাতি ট্রাকে পণ্য তুলে দিলে পরদিন চট্টগ্রামে পৌঁছে কাস্টমস কার্যক্রমও শেষ করা সম্ভব।
স্টিল আমদানিকারক আমির হোসেন নুরানি জানান, ওসাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত এক কনটেইনার আনতে ১,২০০ ডলার লাগে। কিন্তু সেটি পানগাঁওয়ে আনতে আরও ১,০০০ ডলার খরচ হয়। তার ভাষায়, “এটা যুক্তিযুক্ত নয়।” ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, অতিরিক্ত খরচের পাশাপাশি কাস্টমস জটিলতা ও সময়ক্ষেপণের কারণেও পানগাঁও ব্যবহারে অনাগ্রহ বাড়ছে। কেউ কেউ কনটেইনার হারানো এবং কাস্টমস হয়রানির অভিজ্ঞতাও শেয়ার করেছেন।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ) এই ব্যর্থতার জন্য কাস্টমসকে দায়ী করে। আবার কাস্টমস কর্মকর্তারা কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা ও দূরত্বকে কারণ দেখান। শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেরানীগঞ্জকেন্দ্রিক পরিবহন সিন্ডিকেটও খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে আশা জাগাচ্ছে বৈশ্বিক শিপিং জায়ান্ট মেডিটেরেনিয়ান শিপিং কোম্পানির (এমএসসি) প্রস্তাব। তারা সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে ৪০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে পানগাঁও আইসিডি আধুনিকায়ন ও পরিচালনায় আগ্রহ দেখিয়েছে। এমএসসি কনটেইনার ইয়ার্ড সম্প্রসারণ, অটোমেশন ও ডিজিটাল ট্র্যাকিং চালু, এবং নৌপথ ড্রেজিংয়ের পরিকল্পনা করেছে। পাশাপাশি ২৫টি ডেডিকেটেড বার্জ চালু করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, মোংলা, কলম্বো ও সিঙ্গাপুরে ফিডার সার্ভিস চালাবে। টেক্সটাইল শিল্পের জন্য বিশেষ তুলার গুদামও গড়ে তোলা হবে। সিপিএর সদস্য (প্রকৌশল) কমোডর কাওসার রশিদ নিশ্চিত করেছেন, এমএসসি ২৫টি জাহাজের বহর দিয়ে চট্টগ্রাম ও মোংলা থেকে সরাসরি পানগাঁওয়ে কনটেইনার পরিবহন করবে।
নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম. সাখাওয়াত হোসেন জানিয়েছেন, নভেম্বর বা ডিসেম্বরের মধ্যে এমএসসির সঙ্গে চুক্তি হতে পারে। তিনি মনে করেন, এতে দেশের টেক্সটাইল খাত ও লজিস্টিক খাতে গতি আসবে। ব্যবসায়ীরা আশাবাদী যে, এমএসসির প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওপর চাপ কমবে। তবে সমালোচকেরা সতর্ক করছেন, বিদেশি কোম্পানি নিয়ন্ত্রণ নিলে ট্যারিফ ও খরচ আরও বাড়তে পারে।

