সরকার চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে পণ্য ও সেবা রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৬৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। এই লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণার তথ্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি বৈঠকে প্রকাশিত হয় ২০২৫ সালের ১২ আগস্ট।
বৈঠকে উপস্থিত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশের রফতানি খাত আরও শক্তিশালী করতে বিভিন্ন নীতিমালা ও সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হচ্ছে। তারা আশা প্রকাশ করেছেন, নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন দেশের অর্থনীতিকে আরও সজীব ও প্রতিযোগিতামূলক করে তুলবে। রফতানি খাতের উন্নয়ন এবং বাজার সম্প্রসারণের উদ্যোগকে কেন্দ্র করে সরকারের পক্ষ থেকে বেসরকারি খাতের সঙ্গে সমন্বয় বাড়ানোর কথাও উঠে আসে বৈঠকে। বিশেষ করে নতুন বাজার অন্বেষণ এবং উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি করার ওপর জোর দেওয়া হবে।
সরকার চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে পণ্য ও সেবা রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৬৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করেছে। গত ১২ আগস্ট বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে এ লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করা হয়। বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট রফতানি আয় ছিল ৫৫ বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ নতুন অর্থবছরের লক্ষ্য গতবারের তুলনায় প্রায় ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশের মোট রফতানি আয়ের সিংহভাগ অর্থাৎ প্রায় ৮১ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। কাজেই নতুন অর্থবছরের খাতভিত্তিক পরিকল্পনায় তৈরি পোশাক শিল্পকে কেন্দ্র করেই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
খাতভিত্তিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে ওভেন পোশাক থেকে ২০ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার এবং নিট পোশাক থেকে ২৩ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ মোট ৪৪ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। গত অর্থবছরে পোশাক খাত থেকে অর্জিত আয় ছিল ৩৯ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার। নতুন লক্ষ্য পূরণে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানি সমিতি (বিজিএমইএ) ২০৩০ সাল নাগাদ ১০০ বিলিয়ন ডলার পোশাক রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছে।
এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পোশাক শিল্পের অবশ্যই অগ্রণী ভূমিকা থাকবে। তবে এখানে যে বিষয়টি মনে রাখাটা খুবই জরুরি সেটি হলো, যে শিল্প খাত আমাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ড, সে খাতের এক বিশাল অংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তার ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের যেসব প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক রফতানি আয় ৫ মিলিয়ন ডলার বা তার কম, তাদের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বা এসএমই হিসেবে ধরা হয়। কাজেই এ রফতানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানাগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণ ও অবদান অপরিহার্য।
কিন্তু প্রশ্ন হলো এ রফতানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো অবদান রাখতে কতটা প্রস্তুত? কারণ ক্ষুদ্র ও মাঝারি পোশাক কারখানাগুলো বড় বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। বৃহৎ শিল্প কারখানার তুলনায় তাদের আর্থিক সক্ষমতা ও দরকষাকষির ক্ষমতা সীমিত। ক্রেতাদের সঙ্গে দরকষাকষিতে দুর্বল অবস্থানে থাকায় তারা প্রায়ই কম দামে অর্ডার নিতে বাধ্য হয়। তাছাড়া ব্যাংক খাতে সহজে ঋণ বা ক্রেডিট সুবিধা না পাওয়া, গ্যাস-বিদ্যুতের অনিশ্চিত সরবরাহ এবং শুল্ক জটিলতার মতো সমস্যাগুলো ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ মনে রাখতে হবে, আজকের প্রতিটি বৃহৎ কারখানাই একসময় ক্ষুদ্র বা মাঝারি আকারে যাত্রা শুরু করেছিল। সুতরাং ক্ষুদ্র শিল্পকে টিকিয়ে রাখাই বৃহৎ শিল্পের ভবিষ্যৎ নিশ্চিতে অপরিহার্য।
কভিড-পরবর্তী সময় থেকে শিল্প খাত যখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, তখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এ সংকটে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানাগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অর্থনৈতিক মন্দা, ব্যয় বৃদ্ধি ও নানা নীতিগত জটিলতা তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাকে কঠিন করে তুলেছে।
স্থানীয় সমস্যার পাশাপাশি বৈশ্বিক নানা কারণে এসএমই কারখানাগুলো বর্তমানে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিযোগিতা দিন দিন জটিল হয়ে উঠছে। অটোমেশন ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স অর্থাৎ এআই বিশ্বব্যাপী উৎপাদন ব্যবস্থায় দ্রুত প্রবেশ করছে। অটোমেশনের এ ঢেউ বাংলাদেশের ক্ষুদ্র কারখানাগুলোকে ঝুঁকিতে ফেলছে। এরই মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান টিকে থাকতে না পেরে বন্ধ হয়ে গেছে। যেসব প্রতিষ্ঠান সক্রিয় আছে, তারা সাবকন্ট্রাক্টিংয়ের ওপর নির্ভর করছে, কিন্তু সেখানে মুনাফা কম। ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাত ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ছে, যা পুরো তৈরি পোশাক খাতের ভবিষ্যতের জন্য হুমকিস্বরূপ।
এ প্রেক্ষাপটে রফতানি খাতকে এগিয়ে নিতে নীতিনির্ধারকদের দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) শুল্কসংক্রান্ত প্রক্রিয়া সহজতর করতে হবে, বিশেষ করে আমদানীকৃত কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামের ছাড়পত্রে জটিলতা কমাতে হবে। নন-বন্ডেড কারখানার জন্য বিদ্যমান নিয়মে ব্যাক-টু-ব্যাক এলসির মাধ্যমে কাঁচামাল কেনার যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তা সংস্কার করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য স্বল্পসুদে ঋণপ্রাপ্তি সহজ করা, লাইসেন্স ও নবায়ন ফি কমানো এবং ব্যাংক খাতে বিশেষ সুবিধা প্রদান জরুরি। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে পরিচর্যা করতে একটি বিশেষ এসএমই উন্নয়ন তহবিল বা এসএমই ডেভেলপমেন্ট ফান্ড গঠন করা যেতে পারে। যেন এ তহবিল ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তারা সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদে ঋণ পেতে পারেন। এতে শিল্পের প্রবৃদ্ধি বেগবান হবে। ফলে সামগ্রিক রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সহজ হবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির স্বার্থে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে রক্ষা করা এখন সময়ের দাবি। টিকে থাকার জন্য তাদের আর্থিক সহায়তা, নীতিগত সুবিধা ও অবকাঠামোগত সহায়তা দিতে হবে। কারণ এ খাতই একসময় বৃহৎ শিল্পে রূপান্তর হয়ে জাতীয় অর্থনীতিকে আরো শক্তিশালী করবে। আর ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অবদান ছাড়া ২০৩০ সাল নাগাদ ১০০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা নিঃসন্দেহে কঠিন হয়ে পড়বে।
আশিকুর রহমান তুহিন: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, টেড গ্রুপ ও সাবেক পরিচালক, বিজিএমইএ।