বাংলাদেশ গত তিন দশকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং উৎসাহব্যঞ্জক অভিযাত্রা অতিক্রম করেছে। তৈরি পোশাক শিল্পের দ্রুত উত্থান, প্রবাসী আয়ের ধারাবাহিক প্রবাহ, দারিদ্র্য হ্রাস, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং অবকাঠামো বিনিয়োগ প্রতিটি ক্ষেত্রে দেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত হয়েছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল এবং যমুনা রেলসেতু বাংলাদেশের সক্ষমতার উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
তবে অর্থনৈতিক সাফল্যের এই আলোছায়ার মধ্যে কিছু সংকটও জমে আছে। এই সংকটগুলো উপেক্ষা করলে টেকসই উন্নয়নের পথ কঠিন হয়ে যাবে। সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের গ্লোবাল ফিনডেক্স রিপোর্ট ২০২৫ এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য দেশের বাস্তব পরিস্থিতি স্পষ্ট করেছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, আর্থিক অন্তর্ভুক্তির হার কমছে এবং রাজস্ব আহরণে দীর্ঘস্থায়ী ব্যর্থতা দেখা দিয়েছে। এই দুই খাতের দুর্বলতা দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির মূল কাঠামোকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে এবং স্থিতিশীলতার জন্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি উদ্বেগজনকভাবে কমেছে। ২০২৪ সালের হিসাব অনুযায়ী, ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সী জনগোষ্ঠীর মাত্র ৪৩ শতাংশ ব্যাংক বা মোবাইল মানি অ্যাকাউন্টধারী। ২০২১ সালে এই হার ছিল ৫৩ শতাংশ। অর্থাৎ তিন বছরের ব্যবধানে অন্তর্ভুক্তি ১০ শতাংশ পয়েন্ট কমেছে। এর সঙ্গে বিশ্বব্যাপী ব্যাংকিং অন্তর্ভুক্তির হার তুলনা করলে চিত্র আরও উদ্বেগজনক। বিশ্বে এটি ৭৪ থেকে ৭৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ৮৯ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কা ৮০ শতাংশের ওপরে অবস্থান করছে। বাংলাদেশ কেবল পাকিস্তানের চেয়ে সামান্য এগিয়ে।
মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) ক্ষেত্রেও অবস্থা হতাশাজনক। ২০২১ সালে যেখানে ২৯ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এমএফএস ব্যবহার করতেন, সেখানে ২০২৪ সালে হার নেমে এসেছে ২০ শতাংশে। ব্যাংক হিসাবধারীর হারও ২৪ শতাংশ থেকে কমে ২৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে ব্যাংক কর্মকর্তা মনে করেন, এনআইডিভিত্তিক একক হিসাব চালুর কারণে ভুয়া অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়েছে। তবে গভীরে রয়েছে গ্রাহকের আস্থাহীনতা, সেবার মানের ঘাটতি এবং ব্যাংকিং খাতের ক্রমবর্ধমান দুর্বলতা। সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো নারী-পুরুষের আর্থিক বৈষম্য। ২০২১ সালে যেখানে জেন্ডার গ্যাপ ছিল ১৯ শতাংশ পয়েন্ট, ২০২৪ সালে তা বেড়ে ২১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে পুরুষদের মধ্যে ৫৪ শতাংশের ব্যাংক বা এমএফএস অ্যাকাউন্ট থাকলেও নারীর ক্ষেত্রে এটি মাত্র ৩৩ শতাংশ। নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের পথে এ বৈষম্য এক অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করছে।
বাংলাদেশে ১২ কোটি ২৮ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে ৬ কোটি ৯৭ লাখের কোনো ধরনের ব্যাংকিং বা আর্থিক অ্যাকাউন্ট নেই। এর ফলে অর্থনীতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে আর্থিক প্রবাহের বড় অংশ এখনও অনানুষ্ঠানিক খাতেই রয়ে গেছে। অন্যদিকে রাজস্ব খাতের চিত্রও আশাব্যঞ্জক নয়। টানা ১৩ বছর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আহরণ হয়েছে ৩ লাখ ৭০ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা, যা সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৯২ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা কম। প্রাথমিকভাবে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলেও বছরের মাঝপথে কমানো পরেও সেটি অর্জিত হয়নি। ফলশ্রুতিতে উন্নয়ন প্রকল্পে বিলম্ব ঘটছে, ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট বাড়ছে এবং সরকার আরও বেশি ঋণনির্ভর হয়ে পড়ছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে উন্নয়ন বাজেটের বাস্তবায়ন মাত্র ৪৯ শতাংশ হয়েছে।
রাজস্ব সংকটের মূল কারণ ইতোমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে এসেছে—কর ফাঁকি, কর অব্যাহতির অপব্যবহার এবং প্রশাসনিক দুর্বলতা। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে কেবল কর ফাঁকির কারণে সরকার ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারিয়েছে। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি অর্থ এসেছে করপোরেট খাত থেকে। রাজস্ব ঘাটতি পূরণে সরকার ক্রমশ অভ্যন্তরীণ ঋণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। ফলে সুদের খরচ বেড়ে গেছে, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কঠিন হচ্ছে, ভোক্তা ব্যয় কমছে এবং প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পখাত, যা মূল কর্মসংস্থানের উৎস, সবচেয়ে বেশি তহবিল বঞ্চিত হচ্ছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে ব্যয় ব্যবস্থাপনায় কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরেছে। পদ্মা সেতু ও যমুনা রেলসেতু দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এবং উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতিকে নতুন সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে। বিশ্বব্যাংকও বাংলাদেশের ব্যাংক খাত, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং রাজস্ব প্রশাসনে কাঠামোগত সংস্কারকে ইতিবাচকভাবে দেখছে।
বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিকভাবে এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। টেকসই উন্নয়নের জন্য রাজস্ব আহরণের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তির প্রসার—এই দুই দিককে সমান্তরালে এগিয়ে নিতে হবে। কর প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও অটোমেশন নিশ্চিত করতে হবে। কর ফাঁকি দমনে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে করনীতি হতে হবে প্রতিযোগী দেশের তুলনায় বিনিয়োগবান্ধব। ব্যাংক ও মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসে আস্থা ফিরিয়ে আনতে উদ্ভাবনী সেবা, গ্রাহক সুরক্ষা এবং নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। নারীর জন্য আলাদা প্রণোদনা ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালানোও জরুরি।
বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হলো রাজস্ব, আর তার স্নায়ুতন্ত্র হলো আর্থিক অন্তর্ভুক্তি। এই দুই ক্ষেত্রকে শক্তিশালী না করলে দেশের উন্নয়ন টেকসই হবে না। এখন সময় এসেছে কাঠামোগত সংস্কার এবং বাস্তবায়নের। একটি দেশের উন্নয়ন শুধু অবকাঠামো নির্মাণে নয়, মানুষের অন্তর্ভুক্তি এবং আস্থার ওপরও নির্ভর করে। বাংলাদেশের জন্য আস্থা ও অন্তর্ভুক্তির নতুন যাত্রা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে ক্রমাগত মতবিরোধ এবং গন্তব্যের অস্পষ্টতা এ পথে বাধা সৃষ্টি করছে।
উন্নয়নশীল অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হলো অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণ এবং জনগণের অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ। বাংলাদেশে রাজস্ব আহরণের হার দীর্ঘদিন ধরে কম এবং এটি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার পর্যায়ে পৌঁছায়নি। দেশের অর্থনীতি টেকসই রাখতে হলে রাজস্ব সংকট উত্তরণ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি—এই দুই ক্ষেত্রকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। যদি উন্নয়নের সুফল সমাজের প্রতিটি স্তরে পৌঁছে, তাহলে অর্থনীতির অগ্রযাত্রা হবে কেবল সংখ্যাগত প্রবৃদ্ধি নয়, বরং ন্যায়ভিত্তিক এবং সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে রাজস্ব আহরণের সক্ষমতা বৃদ্ধি, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি প্রসার এবং মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা জরুরি। কর প্রশাসনে স্বচ্ছতা, ব্যাংক ও মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সেবায় নিরাপত্তা, এবং নারীর জন্য আলাদা প্রণোদনা কার্যকর করতে হবে। কেবল অবকাঠামোর নয়, মানুষের অন্তর্ভুক্তি ও সমান সুযোগের ওপর দাঁড়িয়ে অর্থনীতি সত্যিকারের শক্তিশালী ও টেকসই হবে।