এই বছরের বাংলাদেশ বিজনেস অ্যাওয়ার্ডে ‘বর্ষসেরা ব্যবসায়ী’ নির্বাচিত হয়েছেন প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আহসান খান চৌধুরী।
পুরস্কারটি বাংলাদেশে অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি জানাতে প্রতি বছর আয়োজন করে ডিএইচএল এক্সপ্রেস বাংলাদেশ ও দ্য ডেইলি স্টার। এটি ছিল এই পুরস্কারের ২৩তম আয়োজন।
একান্ত সাক্ষাৎকারে আহসান খান চৌধুরী জানিয়েছেন, ছোট একটি পারিবারিক ব্যবসা থেকে প্রাণ-আরএফএল কিভাবে বাংলাদেশের বৃহৎ ও বহুমুখী গ্রুপে রূপ নিয়েছে। বর্তমানে এখানে রয়েছে ছয় হাজারের বেশি পণ্য, ১ লাখ ৬৭ হাজার কর্মী এবং বার্ষিক ৩ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা টার্নওভার।
‘১৯৯২ সালে আমি বাবার ব্যবসায় যোগ দিই। তখন আমরা মাত্র ৩০–৪০ জনের একটি দল ছিলাম। কোম্পানির টার্নওভার ছিল মাত্র এক কোটি টাকা। কিন্তু আমার স্বপ্ন ছিল প্রতিষ্ঠানটিকে দেশের সেরা কোম্পানিতে রূপান্তরিত করা,’ তিনি বলেন।
বাবার স্বপ্ন, সন্তানের মিশন
প্রাণ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত মেজর জেনারেল (অব.) আমজাদ খান চৌধুরী ১৯৮১ সালে ব্যবসার ভিত্তি স্থাপন করেন।
আহসান খান চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসায় শিক্ষা নিয়ে ১৯৯২ সালে দেশে ফিরে বাবার সঙ্গে কাজ শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা কৃষি ও খাদ্য শিল্পকে দেশের মূল শক্তি হিসেবে দেখতেন। আমি সেই বিশ্বাসকে উত্তরাধিকারসূত্রে নিয়েছি।’
প্রাণের প্রাথমিক উদ্যোগ ছিল আনারসসহ স্থানীয় ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ ও ক্যানজাতকরণ। ধীরে ধীরে তারা জুস, সস, আচার ও স্ন্যাকস উৎপাদন শুরু করে। এরপর কোম্পানি বিস্তৃত হয় প্লাস্টিক, গৃহস্থালি যন্ত্রপাতি, সাইকেল, জুতা ও ভারী শিল্প খাতে।
কর্মসংস্থান ও গ্রামীণ ক্ষমতায়ন
আহসান খান চৌধুরীর নেতৃত্বে প্রাণ-আরএফএল ছোট একটি কৃষি ব্যবসা থেকে বাংলাদেশের অন্যতম বড় চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে ওঠে। বর্তমানে সরাসরি কর্মরত রয়েছেন ১ লাখ ৬৭ হাজারের বেশি মানুষ।
তিনি বলেন, ‘আমরা ১০ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে চাই। আমাদের লক্ষ্য গ্রামীণ পর্যায়ে বিনিয়োগ ও ক্ষমতায়ন। ভোলায় আমাদের নতুন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক সবচেয়ে বড় প্রকল্প হবে।’
খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ থেকে মৎস্য খাত পর্যন্ত গ্রুপের বিনিয়োগ গ্রামীণ আয়ের স্থিতিশীলতা ও সারাদেশে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা গড়ে তুলতে সহায়তা করছে।
রপ্তানি ও বহুমুখীকরণ
বর্তমানে প্রাণ-আরএফএল ১৪৫টিরও বেশি দেশে রপ্তানি করছে। বার্ষিক রপ্তানি আয় ৫০০ মিলিয়ন ডলার।
‘প্রথমে দেশের বাজার মজবুত করতে হয়, তারপর বিদেশে যাও,’ তিনি ব্যাখ্যা করেন।
আন্তর্জাতিক বাজারে ভিন্ন ভিন্ন চাহিদার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া এবং খাদ্য নিরাপত্তার আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা তাদের কৌশলের অংশ।
বহুমুখীকরণও গ্রুপের প্রধান কৌশল। আনারস ক্যানজাতকরণ থেকে প্লাস্টিক ও সাইকেল উৎপাদন পর্যন্ত প্রাণ-আরএফএল বিস্তৃত হয়েছে। ‘কোকো খাত পিছিয়ে থাকলেও অন্য খাত দিয়ে তা সামলানো হয়। এভাবেই আমরা টিকে থাকি,’ তিনি বলেন।
প্রযুক্তি ও পরবর্তী প্রজন্মের প্রস্তুতি
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় আহসান খান চৌধুরী অভিযোজন, প্রযুক্তি ও তরুণ নেতৃত্ব গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দেন।
‘আমার সন্তানরা ইতোমধ্যেই ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছে। আমরা এমন সংস্কৃতি গড়ে তুলছি, যেখানে নতুন ধারণা ও স্মার্ট চিন্তাধারা নিয়ে পরবর্তী প্রজন্ম বিশ্ববাজারে নামতে প্রস্তুত হবে।’
গ্রুপ রিয়েল-টাইম ডেটা, আন্তর্জাতিক বাজার গবেষণা ও প্রেডিক্টিভ অ্যানালিটিকস ব্যবহার করে পণ্য উন্নয়ন ও ভোক্তা সম্পৃক্ততা বাড়াচ্ছে। তিনি বলেন, ‘যদি নিউইয়র্কে বিক্রি করতে যাই, সেখানে নারায়ণগঞ্জের মতো চিন্তা করা যাবে না। আমাদের মান অনুযায়ী খাপ খাইয়ে নিতে হবে।’
তরুণ উদ্যোক্তাদের বার্তা
‘ইতিবাচক থাকো। দেশে থাকো। কঠোর পরিশ্রম করো। দেশেই কিছু গড়ে তোলো,’ আহসান খান চৌধুরীর পরামর্শ।
তিনি যোগ করেন, ‘নিজের ওপর বিশ্বাস রাখো, ঝুঁকি নিতে ভয় পেও না। নৈতিক ব্যবসায় বিশ্বাস রাখো। দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করো।’
নীতিগত প্রত্যাশা
সরকারের প্রচেষ্টা স্বীকার করলেও তিনি মনে করেন, বৃহৎ শিল্পায়নের জন্য আরও নীতি ও সহায়তার প্রয়োজন।
রপ্তানি প্রণোদনা, বাণিজ্য সহজীকরণ, অবকাঠামো উন্নয়ন, লজিস্টিকস উন্নয়ন ও জমি প্রাপ্তিকে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে উল্লেখ করেন।
ভবিষ্যতের লক্ষ্য
বর্তমান বার্ষিক ৩০–৪০ শতাংশ প্রবৃদ্ধির ধারায় তিনি বিশ্বাস করেন, আগামী ২০ বছরে প্রাণ-আরএফএল ২৫ বিলিয়ন ডলারের কোম্পানিতে রূপান্তরিত হবে।
‘আমরা কেবল শুরু করেছি। আমাদের লক্ষ্য বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশকে গর্বিত করা,’ তিনি যোগ করেন।
আহসান খান চৌধুরীর দৃঢ়তা, উদ্ভাবনী দৃষ্টি ও নতুন প্রজন্মকে নেতৃত্ব দেয়ার প্রচেষ্টা দেশে উদ্যোক্তাদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছে।