জাতিসংঘ বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি মূল্যায়নে সহায়তা করতে যাচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এই মূল্যায়ন উত্তরণ স্থগিতের জন্য সহায়ক হতে পারে। তবে এটিকে নিশ্চয়তা হিসেবে দেখা যাবে না।
জাতিসংঘের আন্ডার-সেক্রেটারি জেনারেল ও এলডিসি, ভূমিবেষ্টিত এবং ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র বিষয়ক উচ্চ প্রতিনিধি রাবাব ফাতিমা জানিয়েছেন, আগামী এক মাসের মধ্যেই এ মূল্যায়ন শুরু হবে। ২০২৬ সালের জানুয়ারির মাঝামাঝি শেষ হবে এ প্রক্রিয়া।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এই মূল্যায়ন সম্পন্ন করবেন একজন আন্তর্জাতিক পরামর্শক ও একজন বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞ। লক্ষ্য হলো একটি পূর্ণাঙ্গ ও ভারসাম্যপূর্ণ মূল্যায়ন তৈরি করা। ফাতিমা জানান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আনুষ্ঠানিক অনুরোধের পর জাতিসংঘ এ পদক্ষেপ নিয়েছে। সোমবার নিউইয়র্কে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুসের সঙ্গে বৈঠকেও তিনি বিষয়টি তুলে ধরেন।
নীতিনির্ধারণী সংলাপ কেন্দ্রের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রথম উত্তরণ স্থগিতের সিদ্ধান্ত এসেছিল ২০২১ সালের মূল্যায়নে। তখন রূপান্তরের সময়সীমা তিন বছর থেকে পাঁচ বছরে বাড়ানো হয়, কারণ মহামারি অর্থনীতিতে তীব্র প্রভাব ফেলেছিল। তিনি আরও জানান, এ বছরের নভেম্বরে জাতিসংঘের একটি দল বাংলাদেশ সফর করবে। তখন বাংলাদেশকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য উত্তরণ স্থগিতের দাবি তুলতে হবে।
তার মতে, রাজনৈতিক রূপান্তর ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে করা “স্মুথ ট্রানজিশন স্ট্রাটেজি (এসটিএস)” অনুযায়ী অগ্রগতি সন্তোষজনক হয়নি। বাংলাদেশ চাইলে এটিকে যুক্তি হিসেবে জাতিসংঘের সামনে উপস্থাপন করতে পারে। তবে তিনি সতর্ক করেন, যদি শুধু তিনটি সূচকের ওপর ভিত্তি করে আলোচনা হয়, তাহলে বাংলাদেশের দাবি দুর্বল হতে পারে, কারণ সেসব সূচকে দেশ ইতোমধ্যেই শক্ত অবস্থানে আছে।
তিনি আরও উদাহরণ টেনে বলেন, জলবায়ুর ঝুঁকির কারণে সলোমন দ্বীপপুঞ্জের উত্তরণ স্থগিত হয়েছিল। তেলের দামের পতনের কারণে অ্যাঙ্গোলার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। তাই বাংলাদেশ অতিরিক্ত সময় চাইলে ক্ষতির আশঙ্কা নেই। তবে এসটিএস নির্দেশিকার অগ্রগতির দিকেও সবসময় নজর রাখতে হবে।
গবেষণা ও নীতি সমন্বয় উন্নয়ন সংস্থার (র্যাপিড) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক বলেন, এই স্বাধীন মূল্যায়ন সহায়ক হলেও তা স্থগিতের নিশ্চয়তা নয়। তিনি জানান, ব্যবসায়ীরা বিশেষ করে রপ্তানিকারকরা উত্তরণের সময়সীমা নিয়ে উদ্বিগ্ন। কারণ উত্তরণের পর আন্তর্জাতিক বাজারে তাদের প্রতিযোগিতা কমে যেতে পারে। এজন্য তারা অন্তত ছয় বছরের স্থগিত দাবি করছেন।
তার মতে, বাংলাদেশ চাইলে নেপালের সঙ্গে যৌথভাবে জাতিসংঘের কাছে যেতে পারে। নেপালও রাজনৈতিক রূপান্তরের মুখে রয়েছে এবং উত্তরণের তালিকায় আছে। যৌথ আবেদন করলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিষয়টিকে গুরুত্ব দেবে। বর্তমানে বাংলাদেশ, নেপাল ও লাওস উত্তরণের তালিকায় রয়েছে। তবে চূড়ান্তভাবে স্থগিত চাইলে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যেতে হবে।
অন্যদিকে এক খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এলডিসি উত্তরণের ইতিহাসে এ ধরনের স্বাধীন মূল্যায়নের নজির নেই। সাধারণত মূল্যায়ন আলাদাভাবে সম্পন্ন হয়। তাই নতুন করে এ প্রক্রিয়ার প্রয়োজন নেই।
অর্থনীতিবিদরা আরও মনে করিয়ে দেন, উত্তরণের পর বাংলাদেশের রপ্তানি খাত বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া গেলেও ২০২৯ সাল থেকে সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ শুল্ক গুনতে হতে পারে। তখন তিন বছরের বিশেষ ছাড়ও শেষ হবে। একইভাবে কানাডা ও জাপানে শুল্ক বাড়বে। আর ওষুধশিল্পকে আন্তর্জাতিক পেটেন্ট আইন মেনে চলতে হবে, যা ওষুধের দাম বাড়িয়ে দিতে পারে।