গত অর্থবছরের (২০২৪–২৫) প্রথম ছয় মাসের ধাক্কা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। জোরালো রপ্তানি আয়, ইতিহাসের সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি এ পুনরুদ্ধারে প্রধান ভূমিকা রেখেছে। গতকাল মঙ্গলবার প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। সংস্থাটির ঢাকা কার্যালয়ের সিনিয়র অর্থনীতিবিদ নাজমুস সাদাত খান প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন।
বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি ২০২৫–২৬ অর্থবছরে দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হবে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ, আর পরের অর্থবছরে তা বাড়বে ৬ দশমিক ৩ শতাংশে। তবে এ প্রবৃদ্ধির গতি টেকসই করতে হলে কর্মসংস্থান সংকোচন, দারিদ্র্য বৃদ্ধি ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি মোকাবিলা করতে হবে। সংস্থাটির মতে, এসব চ্যালেঞ্জ দীর্ঘ মেয়াদে সামাজিক বৈষম্য বাড়াতে পারে।
‘বাংলাদেশ আপডেট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রবৃদ্ধি বাড়লেও দারিদ্র্য ও কর্মসংস্থান সূচকে উদ্বেগ বাড়ছে। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে জাতীয় দারিদ্র্যের হার বেড়ে হয়েছে ২১ দশমিক ২ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরে ছিল ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। একই সময়ে কর্মসংস্থান–জনসংখ্যা অনুপাত ২ দশমিক ১ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৫৬ দশমিক ৭ শতাংশে। বেকারত্বের হার বেড়ে হয়েছে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ।
প্রতিবেদন বলছে, সাম্প্রতিক মাসগুলোয় মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও তা এখনো উচ্চপর্যায়ে রয়েছে। আগস্টে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৩ শতাংশ। বিনিয়োগ স্থবিরতা, দুর্বল ব্যাংক খাত, খেলাপি ঋণ এবং রাজস্ব আদায়ে দুর্বলতা বাংলাদেশের জন্য এখনো বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে কর্মসংস্থান সংকট সবচেয়ে উদ্বেগজনক। বর্তমানে প্রায় ৩০ লাখ কর্মক্ষম মানুষ শ্রমবাজারের বাইরে রয়েছেন, যাঁদের মধ্যে ২৪ লাখ নারী।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রথম প্রান্তিকের বড় ধাক্কায় ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি সামান্য কমে ৪ দশমিক ২ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। বিনিয়োগ স্থবিরতা, উচ্চ সুদের হার ও উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধিই এর প্রধান কারণ। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমে গেছে। মূলধনি পণ্যের আমদানি কমে যাওয়ায় নতুন প্রকল্প ও মূলধনি ব্যয়ও স্থগিত হয়েছে।
বিশ্বব্যাংক বলছে, জিডিপি বাড়লেও নতুন চাকরি তৈরি হচ্ছে না। শিল্প ও সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি থাকলেও গড়ে কর্মসংস্থান কমেছে ২ দশমিক ৬ শতাংশ। সেবা খাতেই এই পতন সবচেয়ে বেশি। কৃষিক্ষেত্রে কিছুটা উন্নতি হলেও তা ঘাটতি পূরণে যথেষ্ট নয়। তৈরি পোশাক খাত রপ্তানি আয়ে বড় অবদান রাখছে, তবে কর্মসংস্থানের সংকট কাটাতে তা যথেষ্ট নয়।
প্রতিবেদনে ব্যাংক খাতের দুর্বলতাও তুলে ধরা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী নীতিমালা সামঞ্জস্যের পর ২০২৫ সালের মার্চে অকার্যকর ঋণ (এনপিএল) বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪ দশমিক ১ শতাংশে, যা দক্ষিণ এশিয়ার গড় ৭ দশমিক ৯ শতাংশের চেয়ে অনেক বেশি। একই সময়ে মূলধন-ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ অনুপাত (সিআরএআর) কমে ৬ দশমিক ৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা ন্যূনতম মানদণ্ড ১০ শতাংশের নিচে। বিশ্বব্যাংক সতর্ক করেছে, শিথিলতা নীতিমালা প্রত্যাহার হলে এনপিএল আরও বাড়তে পারে।
রাজস্ব কাঠামো নিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘাটতি মোকাবিলায় অন্তর্বর্তী সরকার করনীতি ও প্রশাসনের বিভাজন, কর ব্যয়ের ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন এবং ব্যক্তিগত করদাতাদের জন্য অনলাইন কর দাখিল বাধ্যতামূলক করেছে। তবুও রাজস্ব ঘাটতি ২০২৩–২৪ অর্থবছরের ৩ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২৪–২৫ সালে আনুমানিক ৪ দশমিক ৭ শতাংশে পৌঁছেছে।
সংবাদ সম্মেলনে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ও ভুটানের বিভাগীয় পরিচালক জ্যঁ পেম বলেন, টেকসই প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান বাড়াতে সাহসী সংস্কার ও দ্রুত বাস্তবায়ন দরকার। বিশেষ করে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা দূর করা, জ্বালানি ভর্তুকি কমানো, নগরায়ণ পরিকল্পনা শক্ত করা এবং বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করা জরুরি।

