চট্টগ্রাম বন্দরের (সিপিএ) সাম্প্রতিক ট্যারিফ বৃদ্ধিটি ছিল বহুদিনের বিলম্বিত সমন্বয়। শেষবার যে ডলারভিত্তিক হার পরিবর্তন হয়েছিল, তা ১৯৮৬ সালে কিন্তু যা অনেকেই জানে না, তা হলো—সেই সময়ের পর টাকার মান অনেক কমে গেছে। ফলে বন্দরের আয় আগেই কয়েকগুণ বেড়ে গেছে।
তখন এক ডলারের বিনিময় হার ছিল ২৭ টাকা। আজ তা প্রায় ১২২ টাকায় পৌঁছেছে। অর্থাৎ, ট্যারিফ না বাড়িয়েও বন্দরের টাকায় আয় চারগুণেরও বেশি বেড়ে গেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দরের আয় হয়েছে ২,৯১৩ কোটি টাকা—এক রেকর্ড। এই অবস্থায় স্বাভাবিক প্রশ্ন হলো—অর্থনীতি যখন চাপের মুখে, ব্যবসায়ীরা খরচে জর্জরিত, আর রপ্তানিকারকরা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার লড়াই করছে, তখন কেন এই ট্যারিফ বৃদ্ধি করা হলো? এ বিষয়ে ব্যবসায়ী ও বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন মাশুল মূলত বিদেশি অপারেটরদের সুবিধার দিকে মনোযোগী। আর স্থানীয় ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত খরচের বোঝা বহন করবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের নতুন ট্যারিফ কাঠামোটি বিশ্বব্যাংক গ্রুপের বেসরকারি খাতের শাখা ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি)-এর প্রস্তাবিত কাঠামোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিলে যায়। সরকার ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (সিপিএ) পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করে আইএফসি পতেঙ্গা ও লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনালের কনসেশন চুক্তি তৈরি করেছে।
আইএফসি’র মূল লক্ষ্য ছিল—চট্টগ্রাম বন্দরকে বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তোলা। তবে সমালোচকদের অভিযোগ, নতুন ট্যারিফ কাঠামো সিপিএ’র চেয়ে বিদেশি অপারেটরদের বেশি সুবিধা দিচ্ছে। সমালোচনা আরও জোরদার হয়েছে কারণ আইএফসি একদিকে বন্দর নীতিমালার পরামর্শক, অন্যদিকে বাংলাদেশে বন্দর প্রকল্পে বিনিয়োগকারী হিসেবেও যুক্ত হতে চাচ্ছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, এটি স্পষ্টভাবে স্বার্থের সংঘাতের ইঙ্গিত দেয়।
সিপিএ’র সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সিঙ্গাপুরের বন্দর অপারেটর পিএসএ-কে ১.৫ বিলিয়ন ডলারের বে টার্মিনাল প্রকল্পে অর্থায়ন করতে প্রস্তুত আইএফসি। বন্দর কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সোহেল ও এম শাহজাহান প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন, পিএসএ ওই প্রকল্পের জন্য আইএফসি থেকে অর্থায়ন পাবে।
এম শাহজাহান বলেন, “পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের চুক্তিকে ভবিষ্যৎ সব কনসেশনের মানদণ্ড ধরা হচ্ছে। যদি আইএফসি সেখানে বেসরকারি অপারেটরদের অনুকূলে শর্ত নির্ধারণ করে, তাহলে একই শর্ত বে টার্মিনাল ও মাতারবাড়ী প্রকল্পেও প্রয়োগ হবে—যেখানে তাদের নিজস্ব আর্থিক স্বার্থ জড়িত।” অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আনু মুহাম্মদ বলেন, “যখন বিশ্বব্যাংক কোনো বন্দর প্রকল্পে অর্থায়নকারী, তখন আইএফসি’র পক্ষে একই প্রকল্পের নীতিগত কাঠামো তৈরি করা সরাসরি স্বার্থের সংঘাত।”
অর্থনীতিবিদ এম মাসরুর রিয়াজ, যিনি এক সময় আইএফসি’তে কর্মরত ছিলেন তিনি বলেন, “শোনা যাচ্ছে বে টার্মিনাল প্রকল্পে আইএফসি সিঙ্গাপুরের পিএসএ-কে অর্থায়ন করতে পারে, যদিও এটি এখনো নিশ্চিত নয়। তবে যদি আইএফসি বে টার্মিনালের জন্য কনসেশন উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করে, তাহলে এটি নিঃসন্দেহে স্বার্থের সংঘাত সৃষ্টি করবে। সিপিএ’র উচিত বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা।” তিনি আরও বলেন, বে টার্মিনালটি ‘বিল্ড, ইকুইপ, অপারেট’ মডেলে নির্মিত হচ্ছে, যেখানে সিপিএ’র প্রচলিত ট্যারিফ কাঠামো প্রযোজ্য নাও হতে পারে।
২০২৪ সালের ২৮ জুন বিশ্বব্যাংকের নির্বাহী পরিচালকদের বোর্ড গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প বে টার্মিনাল নির্মাণে বাংলাদেশকে সহায়তায় ৬৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণ অনুমোদন করে। পরবর্তীতে ২০২৫ সালের ২৩ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে এই অর্থায়ন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ঋণ অনুমোদনের সময় বিশ্বব্যাংকের আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে বলা হয়, “এছাড়াও, বিশ্বব্যাংক গ্রুপের বেসরকারি খাতের শাখা আইএফসি প্রস্তাবিত বেসরকারি খাতনির্ভর টার্মিনালগুলোর একটিতে বিনিয়োগের বিষয়টি বিবেচনা করছে।”
বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও প্রকল্পটির দলনেতা হুয়া তান মন্তব্য করেন, “বে টার্মিনাল প্রকল্প দেশের সমুদ্রবন্দর অবকাঠামো আধুনিকায়নে সহায়তা করবে এবং বাংলাদেশের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক সংযোগ আরও জোরদার করবে।” কিন্তু এই ঘোষণার আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে সম্ভাব্য স্বার্থসংঘাতের প্রশ্ন। কারণ, আইএফসি—যে প্রতিষ্ঠান সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে বন্দরের কার্যক্রমকে আরও আকর্ষণীয় করতে ট্যারিফ বাড়ানোর বিষয়ে—একই সঙ্গে একই ধরনের প্রকল্পে নিজেই বিনিয়োগের সম্ভাবনা বিবেচনা করছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, যদি আইএফসি এই টার্মিনালগুলোর কোনো একটিতে বিনিয়োগ করে, তাহলে তারা এমন একটি প্রকল্পে সরকারের উপদেষ্টা ও সম্ভাব্য অংশীদার উভয় ভূমিকায় থাকবে—যেখান থেকে আর্থিকভাবে নিজেরাই লাভবান হতে পারে। এতে তাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠবে। এমনকি যদি এই ধারণাও তৈরি হয় যে, আইএফসি টেন্ডারের কাঠামো এমনভাবে তৈরি করেছে যাতে তাদের অর্থায়নকৃত বা পছন্দের কোনো কোম্পানি সুবিধা পায়, তাহলে পুরো প্রক্রিয়া নিয়েই আস্থার সংকট সৃষ্টি হবে।
এই উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে আইএফসি’র নিজস্ব কমপেনসেশন মডেল, যেখানে “সাকসেস ফি” বা সফলতা ফি অন্তর্ভুক্ত থাকে। এটি সাধারণত প্রকল্পের মোট মূল্যের একটি নির্দিষ্ট অংশ, যা সরকার-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পর প্রদান করা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই কাঠামো এমন এক ধরনের চাপ তৈরি করতে পারে, যাতে দ্রুত চুক্তি সম্পন্ন হয়—even যদি শর্তগুলো সরকারের জন্য পুরোপুরি অনুকূল না হয়।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, “সরকার যখন বন্দরের ট্যারিফ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়, তখনই স্পষ্ট হয় এটি বিদেশি অপারেটরদের সুবিধা দেওয়ার জন্য করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর ইতিমধ্যেই বিপুল মুনাফায় চলছে—এ অবস্থায় শুল্ক বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই।” তিনি আরও বলেন, “অতীতে যেখানে যেখানে ডিপি ওয়ার্ল্ড বন্দরের দায়িত্ব নিয়েছে, সেখানে প্রথমেই শুল্ক বাড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক টার্মিনাল অপারেটরদের সুবিধা দিতে সরকার আগেভাগেই লাভজনক টার্মিনালের মাশুল বাড়িয়েছে।”
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ অভিযোগ করেন, “সরকার সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিলেও বন্দরের দক্ষতা বাড়ানোর বদলে আগের স্বৈরশাসনের ধারা অনুসরণ করছে। কোনো উন্মুক্ত দরপত্র ছাড়াই একের পর এক টার্মিনাল বেসরকারি অপারেটরদের হাতে তুলে দিচ্ছে।” আইএফসি তার ‘লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল পিপিপি প্রজেক্ট ট্রানজাকশন স্ট্রাকচার রিপোর্ট’-এ সতর্ক করেছিল যে, বাংলাদেশের কঠোর ও অপরিবর্তনীয় ট্যারিফ নীতি আন্তর্জাতিক টার্মিনাল অপারেটরদের (আইটিও) বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করতে পারে। প্রতিষ্ঠানটি সেখানে স্পষ্টভাবে সুপারিশ করেছিল—“নিশ্চিত ট্যারিফ সংস্কার, যার মধ্যে ট্যারিফ বৃদ্ধির নিশ্চয়তা অন্তর্ভুক্ত থাকবে”—যা প্রকল্পের সফলতার অন্যতম শর্ত হিসেবে বিবেচিত হবে।
এখন সেই পরামর্শই বাস্তবে রূপ নিয়েছে। সরকার বে টার্মিনালের দুটি কনটেইনার বার্থ থেকে শুরু করে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর পর্যন্ত সব নতুন টার্মিনাল বেসরকারি খাতে লিজ দেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে বাধ্য হয় এক ব্যাপক ট্যারিফ পুনর্বিন্যাসে। মূলত বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বাজারকে “আর্থিকভাবে আকর্ষণীয়” করে তুলতেই হঠাৎ এই বড় পরিসরের ট্যারিফ বৃদ্ধি কার্যকর করা হয়েছে।
এই ট্যারিফ বৃদ্ধির সুবিধাভোগী শুধু ভবিষ্যতের নতুন বিনিয়োগকারীরাই নয়, বর্তমান পরিচালনাকারীরাও। সৌদি আরবভিত্তিক রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনাল (আরএসজিটিআই) ইতিমধ্যে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনা করছে। অন্যদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বন্দর অপারেটর ডিপি ওয়ার্ল্ড খুব শিগগিরই নিউ মুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি)-এর নিয়ন্ত্রণ নিতে যাচ্ছে—যা এককভাবে চট্টগ্রাম বন্দরের মোট কনটেইনার পরিবহনের প্রায় ৪০ শতাংশ পরিচালনা করে।
এদিকে ডেনমার্কের শিপিং জায়ান্ট এ.পি. মোলার মায়েরস্ক নজর রেখেছে লালদিয়া টার্মিনাল কনসেশনের দিকে—যার কাঠামো তৈরি করেছে আইএফসি নিজেই। সংশোধিত ট্যারিফ সূচির বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ) এবং আন্তর্জাতিক টার্মিনাল অপারেটর—উভয়েরই আয় বাড়বে। তবে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে বেসরকারি বিদেশি অপারেটররা। বিশেষ করে যেসব সেবা সরাসরি তাদের আয়ের উৎস—যেমন ক্রেন অপারেশন, কনটেইনার লোডিং ও আনলোডিং, স্টোরেজ, রিফার প্লাগ-ইন এবং কনটেইনার চলাচল—এসব খাতে ট্যারিফ গড়ে বেড়েছে প্রায় ১৪৪ শতাংশ। বিপরীতে, সিপিএ-সংক্রান্ত চার্জ যেমন পাইলটেজ, নেভিগেশন ও নদী শুল্ক বেড়েছে প্রায় ৭০ শতাংশ।
মাশুল কাঠামোর বিস্তারিত পর্যালোচনায় পার্থক্যটি আরও স্পষ্ট। উদাহরণস্বরূপ, ২০ ফুটের একটি রিফার কনটেইনারের প্লাগ-ইন চার্জ ৯ ডলার থেকে বেড়ে হয়েছে ২০.৯৬ ডলার—অর্থাৎ ১৩৩ শতাংশ বৃদ্ধি। এই আয় সম্পূর্ণভাবেই টার্মিনাল অপারেটরদের হাতে যাবে। অন্যদিকে, ১০,০০০ গ্রস রেজিস্টার্ড টনের একটি জাহাজের ন্যূনতম পাইলটেজ ফি বেড়েছে ৩৫৭.৫০ ডলার থেকে ৮০০ ডলার, যা ১২৪ শতাংশ বৃদ্ধি; এই অংশের আয় পাবে সিপিএ। তবে কনটেইনার হ্যান্ডলিং, স্টোরেজ ও সংশ্লিষ্ট সেবাই বন্দরের আয়ের মূল অংশ। তাই এই খাতে ট্যারিফ বৃদ্ধির ফলে আন্তর্জাতিক অপারেটররা রয়্যালটি পরিশোধের পরও শেষ পর্যন্ত বন্দর কর্তৃপক্ষের তুলনায় অনেক বেশি আয় করবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল (এলসিটি) প্রকল্প নিয়ে বিতর্কের প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক অর্থ করপোরেশন (আইএফসি) জানিয়েছে, তারা সরকারের পরামর্শক হিসেবে কাজ করছে—কোনো অপারেটর বা ডেভেলপারের পক্ষে নয়। আইএফসির একজন মুখপাত্র বলেন, আইএফসি পিপিপি প্রকল্পের উন্নয়ন, কাঠামোগত নকশা ও বাস্তবায়নে সরকারকে সহায়তা করে। লক্ষ্য হচ্ছে এমন প্রকল্প তৈরি করা যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বেসরকারি অংশীদারদের আকৃষ্ট করবে এবং অবকাঠামো উন্নয়ন হবে স্বচ্ছ ও টেকসইভাবে। তিনি বলেন, সরকারের সক্ষমতা বাড়ানোই আইএফসির উদ্দেশ্য—যাতে সরকার দক্ষতার সঙ্গে অবকাঠামো সরবরাহ করতে পারে। এসব প্রকল্প দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আইএফসি ব্যাখ্যা করে, তারা শুধু পিপিপি লেনদেনের পরামর্শই দেয় না, বরং বিশ্বব্যাপী বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ও নতুন বাজার সৃষ্টিতে কাজ করে। এর মাধ্যমে উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে বেসরকারি মূলধন আকৃষ্ট করা হয়।
সংস্থাটি জানায়, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে তারা পিপিপি কর্তৃপক্ষ ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (সিপিএ) সঙ্গে কাজ করছে। লক্ষ্য হলো বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ ও দক্ষতা কাজে লাগিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনাকে আধুনিক ও কার্যকর করা এবং বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো। আইএফসি আরও জানায়, তাদের রয়েছে বিস্তারিত স্বার্থের সংঘাত ব্যবস্থাপনা নীতি। প্রয়োজনে বিভিন্ন নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়—যেমন তথ্য প্রকাশ, টিম পৃথকীকরণ ও তথ্য শেয়ারের সীমাবদ্ধতা। ফলে বিনিয়োগ দল ও পরামর্শক দল সাধারণত আলাদা থাকে।
লালদিয়া টার্মিনালের বিষয়ে আইএফসি জানায়, প্রকল্পের আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সিপিএকে ট্যারিফ সংশোধন বিবেচনার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। কারণ, এ প্রকল্পের নকশা, অর্থায়ন, নির্মাণ ও বেসরকারি পরিচালনায় বড় ধরনের মূলধন ও খরচ প্রয়োজন হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা প্রায় ২৭ শতাংশ বাড়বে। এলসিটির বার্ষিক সক্ষমতা ধরা হয়েছে ৮ লাখ টিইইউএস, যা জাহাজের অপেক্ষার সময় কমাবে এবং ট্রাক টার্নআরাউন্ড সময় হ্রাসের মাধ্যমে উন্নত সেবা নিশ্চিত করবে। আইএফসি বলছে, তারা সিপিএকে সহায়তা করছে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ঝুঁকি বণ্টন কাঠামো, কার্যকর বন্দর পরিচালনা মানদণ্ড এবং সরকারের জন্য স্থায়ী আর্থিক রিটার্ন নিশ্চিত করতে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ) দাবি করছে, তাদের ট্যারিফ বা মাশুল গত চার দশক ধরে অপরিবর্তিত ছিল। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বলছেন, নতুন সিদ্ধান্তের আগেই খরচ অনেক বেড়ে গিয়েছিল—মূলত ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধির কারণে। তাদের অভিযোগ, সিপিএ অধিকাংশ ট্যারিফ ডলারে নির্ধারণ করে, ফলে টাকার অবমূল্যায়নের সঙ্গে খরচও বেড়ে যায়। উদাহরণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা জানান, ২০২০ সালে এক টিইইউস কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের খরচ ছিল ৪৩ ডলার, অর্থাৎ ৮৫ টাকা বিনিময় হারে ৩,৬৫৫ টাকা। ২০২৪ সালে ডলারের দাম ১২৪ টাকা হওয়ায় একই চার্জ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫,৩৩২ টাকায়। অর্থাৎ, মাত্র চার বছরে খরচ বেড়েছে প্রায় ৪৫ শতাংশ বা ১,৬৭৭ টাকা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলারমূল্যের এই বৃদ্ধিই বন্দরের চার্জকে আগেই “চড়া” করে তুলেছিল।
র্যাপিড-এর চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক বলেন, “সিপিএ একবারে ৪০ শতাংশ না বাড়িয়ে ধাপে ধাপে বাড়ালে ব্যবসায়ীরা চাপ সামলাতে পারতেন। এতে খরচের প্রভাবও হঠাৎ এতটা হতো না।” তিনি আরও বলেন, “ট্যারিফ টাকায় নির্ধারণ করলে ব্যবসায়ীরা ডলারের ওঠা-নামা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকতেন না। এতে খরচ আগে থেকেই অনুমান করা যেত, যা একটি বাস্তবসম্মত সমাধান হতে পারে।”
চট্টগ্রাম বন্দরের নতুন ট্যারিফ বৃদ্ধির ফলে ২০ ফুটের একটি কনটেইনারের গড় খরচ ৯৭ ডলার থেকে বেড়ে হয়েছে ১৩৩ ডলার। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় বৃদ্ধি এসেছে লোডিং ও আনলোডিং চার্জে—৪৩ ডলার থেকে বেড়ে ৬৮ ডলারে। তুলনায় সিঙ্গাপুর ও কলম্বো বন্দরে খরচ এখনো বেশি—সিঙ্গাপুরে প্রতি ২০ ফুটি কনটেইনারে টার্মিনাল হ্যান্ডলিং ফি ১৮০ থেকে ১৯০ ডলার এবং কলম্বোতে ১৫০ থেকে ২৫০ ডলার। কিন্তু এসব বন্দরের দক্ষতা, সময়নিষ্ঠতা এবং দ্রুত জাহাজ টার্নঅ্যারাউন্ড সুবিধা অতিরিক্ত খরচের ভার অনেকটাই লাঘব করে।
সমুদ্র বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, “সিঙ্গাপুর ও কলম্বোতে ট্যারিফ বেশি, কিন্তু চট্টগ্রামে কম থাকা সত্ত্বেও প্রকৃত খরচ আরও বেশি হয়ে যায়।” তিনি ব্যাখ্যা করেন, “সিঙ্গাপুর বন্দরে জাহাজ আগমনের সময়ই বার্থ পায় এবং এক-দুই দিনের মধ্যেই লোড-আনলোড শেষে পরবর্তী গন্তব্যে যেতে পারে। কিন্তু চট্টগ্রামে বার্থ পেতে সময় লাগে দুই থেকে পাঁচ দিন, এরপর আনলোড ও লোড করতে আরও দুই থেকে তিন দিন। অর্থাৎ মোট টার্নঅ্যারাউন্ড সময় দাঁড়ায় ৫–৭ দিন।”
এই অতিরিক্ত সময়ের কারণে জাহাজগুলোকে বন্দরের চার্জ, নদী চার্জ ও লাইট ডিউস দিতে হয়। তার সঙ্গে যুক্ত হয় জাহাজের স্থায়ী পরিচালন খরচ—ফলে সামগ্রিক ব্যয় সিঙ্গাপুর ও কলম্বোর চেয়েও বেশি পড়ে। আনাম চৌধুরী বলেন, “বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের বিষয় হলো, রপ্তানিকারকরা এখন আরও বেশি খরচের মুখে পড়ছেন, অথচ বন্দরের কার্যকারিতা তেমন উন্নত হচ্ছে না।”
ব্যবসায়ীরা সতর্ক করেছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের নতুন ট্যারিফ কাঠামো বিদেশি অপারেটরদের আয় বাড়ালেও স্থানীয় আমদানি-রপ্তানিকারকদের ব্যয় ব্যাপকভাবে বাড়াবে। এর প্রভাব শেষ পর্যন্ত ভোক্তার ওপরই পড়বে—যারা ইতোমধ্যেই উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে রয়েছেন। সিকম শিপিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক বলেন, “সরকারি কর্মকর্তাদের দরকষাকষির দক্ষতার ঘাটতি এখানে স্পষ্ট। আইএফসির সুপারিশ মানার আগে সিপিএর উচিত ছিল ব্যবসায়িক খরচ বাড়ার প্রভাব বিবেচনা করা।”
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ গত ১৮ সেপ্টেম্বর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে চিঠি দিয়ে নতুন ট্যারিফ কাঠামো পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি সতর্ক করেছেন, এই বৃদ্ধির ফলে রপ্তানিমুখী অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং বৈশ্বিক ফ্রেইট মার্কেটে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে।
চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, “ব্যবসায়ীরা আগেই বাড়তি ট্যারিফ দিচ্ছেন ডলারের দরবৃদ্ধির কারণে। শেষবার যখন ট্যারিফ পর্যালোচনা করা হয়েছিল, তখন ডলারের মান ছিল ৫০ টাকারও কম। বর্তমানে তা বেড়ে ১২০ টাকায় পৌঁছেছে।” আরিফের আশঙ্কা, নতুন ট্যারিফ কাঠামো দেশের রপ্তানিমুখী অর্থনীতির প্রতিযোগিতা কমাবে এবং বিশ্ববাণিজ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল করবে।

