বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য বর্তমানে এক অস্থির ও চাপপূর্ণ অবস্থার মধ্যে রয়েছে। আইন-শৃঙ্খলার অবনতি এবং নিরাপত্তা সংকটের কারণে উদ্যোক্তাদের মধ্যে আস্থা ও নিশ্চয়তা কমে গেছে। এতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান—উভয়েই প্রভাব পড়েছে। উচ্চ সুদের হার, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, ক্রয়ক্ষমতার হ্রাস—সব মিলিয়ে শিল্পখাতের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে, আর পণ্যের চাহিদাও শিথিল হয়ে গেছে।
এই পরিস্থিতিতে নতুন ব্যবসা শুরু বা বিদ্যমান উদ্যোগ প্রসারিত করার বিষয়ে উদ্যোক্তাদের আগ্রহ নেই। ব্যবসা স্থবির থাকায় সরকারের রাজস্ব আয়েও প্রভাব পড়েছে। একের পর এক কারখানা বন্ধ হওয়ায় লাখো মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে, বেকারত্ব বেড়েছে এবং দারিদ্র্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হলেও- সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা দেশের অর্থনীতি নিয়ে ক্রমাগত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন এবং সরকারের কাছ থেকে কোনো কার্যকর আশ্বাস পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছেন।
বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষণ-
এক দিন আগে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে একটি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে বড় ধাক্কা লেগেছে এবং সার্বিক অর্থনীতিতে মন্দার ছায়া দেখা যাচ্ছে। বেসরকারি বিনিয়োগ ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে নেমেছে। একইভাবে, বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধিও ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে ঠেকেছে। ব্যাংক খাতের ঋণখেলাপিও রেকর্ড গড়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সর্বশেষ সময়ে ঋণের সুদ বেড়ে ২৪.১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। কর-জিডিপি অনুপাত কমে ৬.৮ শতাংশে নেমেছে, আর বেকারত্ব বেড়ে ৩.৭ শতাংশে পৌঁছেছে।
যদিও রপ্তানিতে কিছু ইতিবাচক ধারা লক্ষ্য করা গেছে, আগস্টে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ৩ শতাংশ এবং সেপ্টেম্বরে ৪.৬১ শতাংশ হারে কমেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ব্যাংক খাতের দুর্বলতাই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি হ্রাসের প্রধান কারণ।
ব্যবসায়ীদের অভিজ্ঞতা ও উদ্বেগ-
সাধারণভাবে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির। আস্থা হারিয়ে ফেলেছে উদ্যোক্তারা। নতুন বিনিয়োগ না হওয়ার পাশাপাশি চলমান ব্যবসা পরিচালনা করতেও এখন ব্যবসায়ীদের সক্ষমতা অর্ধেকের নিচে। পোশাক রপ্তানিতে আগের মতো ইতিবাচক প্রভাব দেখা না যাওয়ায় খাতের কিছু উদ্যোক্তা বলছেন, “ব্যবসা এখন রোগী আইসিইউতে থাকার মতো অবস্থা।”
অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল হাই সরকার বলেন, “সব সূচকই এখন খারাপ। দেশে ব্যবসা-বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নেই। বিভিন্ন স্তরে অনেক ভুল হয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো—নীতিনির্ধারকরা ব্যবসায়ীদের সমস্যা বোঝার চেষ্টা করছেন না। তাঁরা থিওরিটিক্যাল, কিন্তু আমাদের প্র্যাকটিক্যাল বাস্তবতা বোঝেন না। বিনিয়োগের মূল শক্তি হলো জ্বালানি ও বিদ্যুৎ। এগুলো না পেলে অন্য সব কিছু থাকলেও ব্যবসা চলে না।”
বিকেএমইএর সাবেক প্রেসিডেন্ট ফজলুল হক বলেন, “রপ্তানি খাতেও ভাটা শুরু হয়েছে। আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে টানা রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমেছে। ব্যবসা-প্রক্রিয়া এখন শ্বাসরুদ্ধকর। চলছে, কিন্তু স্থিতিশীলতা নেই। সরকার শুধুমাত্র বলে অর্থনীতি চলছে। কিন্তু বাস্তবতা এভাবে নয়। নতুন সরকার না আসা পর্যন্ত অর্থনৈতিক পরিস্থিতি থেকে কোনো প্রত্যাশিত পরিবর্তন হবে বলে মনে হচ্ছে না।”
ঢাকা চেম্বারের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসেন খালেদ বলেন, “সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন গতিহীন। জিডিপির এক-তৃতীয়াংশ আসে সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প থেকে। বরাদ্দ থাকলেও বেসরকারি খাতের বাস্তবায়ন কম। শ্রমিক নিয়োগ, খাদ্য সরবরাহ—সবই সমস্যার মধ্যে। গত এক বছরে সরকারি খাতে নতুন ইকুইটি ইনভেস্টমেন্ট প্রায় নেই। বেসরকারি খাতেও আস্থা ও চাহিদা নেই। মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও কমে গেছে। ফলে ব্যবসা অর্ধেক সক্ষমতায় চলছে।”
নারী উদ্যোক্তাদের দৃষ্টিকোণ-
উইমেন এন্টারপ্রেনার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডব্লিউইএবি) প্রেসিডেন্ট নাসরিন আউয়াল মিন্টু বলেন, “বর্তমানে চলমান অন্তর্বর্তী সরকারের শাসন, যা রাজনৈতিকভাবে দায়বদ্ধ নয়। আইন-শৃঙ্খলার অবনতির কারণে নারীরা অত্যাচার, লুটপাট ও ভল্ট কেটে জুয়েলারি লুটের মতো সমস্যার মুখোমুখি। বিনিয়োগকারীরা স্থিতিশীল রাজনৈতিক সরকারের দিকে তাকিয়ে। নতুন সরকার এলে বিনিয়োগ আশা করা যায়, এখন তারা ভয় পাচ্ছে। এক বছরে বেকারত্ব অনেক বেড়েছে। নারী উদ্যোক্তারাও সংকটের মধ্যে রয়েছেন।”
অ্যাকসেসরিজ খাতের সংকট-
বিজিএপিএমইএর প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, “আমার খাতের ৪৩টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। উচ্চ সুদের হার প্রধান কারণ। আগে ঋণের সুদ ছিল ৯%, এখন ১৬%। জ্বালানি ও ক্রয়াদেশ ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছে না। পণ্যের দাম কমে গেছে। ফলে মালিকরা ব্যবসা চালাতে পারছেন না। নতুন কোনো উদ্যোগ হচ্ছে না। সাড়ে আট হাজার শ্রমিক কর্মহীন হয়েছেন।”
ব্যবসার স্থবিরতা ও কর্মসংস্থানের হ্রাস-
এসময় দেখা যাচ্ছে, একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে লাখো মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছে। সরকারের নজর ও মনোযোগ নেই বলে উদ্যোক্তারা অভিযোগ করেন। অনেকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ হওয়ার কারণে বেতন ও ভাতা প্রদানও সম্ভব হচ্ছে না। কারখানার পরিচালনা কার্যত অচল। কেউ কেউ মামলা-হামলার শিকার হয়ে মানসিক ও আর্থিকভাবে বন্ধ অবস্থায় রয়েছেন। বিদেশে বিনিয়োগ বৈঠকে অংশ নেওয়াও সম্ভব হচ্ছে না।
উদ্যোক্তাদের সমন্বিত অভিমত-
ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সরকারের সঙ্গে নিয়মিত আলাপ প্রয়োজন। তাদের সমস্যাগুলো বোঝা ও সমাধানের পথ বের করা জরুরি। বর্তমান অবস্থায় দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য রোগীর মতো, চললেও স্থিতিশীল নয়। শিল্পকারখানার সাপ্লাই চেইন, ঋণ ও জ্বালানি সরবরাহ—সবই বাধাগ্রস্ত। নতুন সরকার না আসা পর্যন্ত বিনিয়োগ ও ব্যবসার পুনরুজ্জীবন ঘটানো সম্ভব হবে না।
পরিশেষে, সব মিলিয়ে, বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য বর্তমানে চরম অস্থির ও চাপপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা, ঋণ, উচ্চ সুদের হার, ক্রয়ক্ষমতার হ্রাস, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জ্বালানি-বিদ্যুৎ সমস্যার কারণে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ ও ব্যবসা সম্প্রসারণে অনিচ্ছুক। ফলে বেসরকারি খাতের স্থবিরতা, বেকারত্ব বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হ্রাস লক্ষ করা যাচ্ছে। নারী উদ্যোক্তা থেকে অ্যাকসেসরিজ খাত—সব খাতেই সংকট দৃশ্যমান। সরকারের সঙ্গে উদ্যোক্তাদের আলোচনার অভাব ও রাজনৈতিক অস্থিরতা পরিস্থিতি আরো জটিল করছে। নতুন সরকার না আসা পর্যন্ত এই চাপ ও অস্থিরতা ব্যবসায়ীদের আস্থা পুনরুদ্ধার করা এবং দেশের অর্থনীতি সচল রাখার পথে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে থাকবে।

