বাংলাদেশের অর্থনীতি কিছুটা স্থিতিশীল থাকার আশায় ছিলেন অনেকে, বিশেষ করে রফতানি আয়ের ক্ষেত্রে। তবে সাম্প্রতিক দুই মাসের তথ্য দেখাচ্ছে, সেই আশার আলোও ম্লান হতে শুরু করেছে। আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে দেশের পণ্য রফতানি হ্রাস পেয়েছে, যা বাজার বিশ্লেষকদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিরতা, ঋণের উচ্চ সুদ এবং মূল্যস্ফীতির পুনরায় উর্ধ্বগতি দেশের অর্থনীতিকে ভরসাহীন অবস্থায় পৌঁছে দিয়েছে।
অর্থনীতির মূল চ্যালেঞ্জ
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ঋণের সীমাবদ্ধতা, জ্বালানি সংকট এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর নীতি—এই সব কারণে দেশের অর্থনীতি বর্তমানে চাপের মুখে। শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর একাংশ বন্ধ হয়ে গেছে, নতুন বিনিয়োগ স্থগিত রয়েছে। আন্তর্জাতিক ঋণমানের অবনতি, রাজস্ব ঘাটতি এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সীমাবদ্ধতাও সমস্যাকে আরও জটিল করেছে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে এলে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার সম্ভব, তবে অন্তর্বর্তী সরকারের সময় বিনিয়োগে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি দেখা যায়নি। বড় উদ্যোক্তারা এখন বিদেশে অবস্থান করছেন বা নতুন প্রকল্পে ঝুঁকি নিতে অনীহা দেখাচ্ছেন।
রফতানি আয়ে পতন: আগস্ট–সেপ্টেম্বরের উদ্বেগ
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, আগস্টে দেশের রফতানি আয় প্রায় ৩% কমে দাঁড়ায়। এরপর সেপ্টেম্বর মাসে আরও ৪.৬১% হ্রাস রেকর্ড হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই–সেপ্টেম্বর) মোট রফতানি আয় ১২৩১ কোটি ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫.৬৪% বেশি। তবে সাম্প্রতিক দুই মাসের পতন বাণিজ্য বিশ্লেষকদের উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
কমেছে তৈরি পোশাক, হোম টেক্সটাইল, কৃষিপণ্য, পাটজাত পণ্য, চামড়াবিহীন জুতা এবং প্লাস্টিক পণ্যের রফতানি। তুলনায় হিমায়িত খাদ্য, চামড়া ও প্রকৌশল খাতের রফতানি বেড়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক, ইউরোপের চাহিদা হ্রাস এবং কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধিই হ্রাসের মূল কারণ।
এক বিশ্লেষক মন্তব্য করেছেন, “রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং আন্তর্জাতিক বাজারের চাপ স্পষ্টভাবে রফতানিতে প্রভাব ফেলছে। নতুন বিনিয়োগের অভাবে অনেক কারখানা উৎপাদন কমিয়েছে, যা রফতানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।”
বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি: ২২ বছরের নিম্ন স্তরে
উচ্চ সুদ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব পড়েছে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধিতেও। জুন–আগস্টের মধ্যে ঋণ প্রবৃদ্ধি ৭%-এর নিচে নেমে গেছে। আগস্টে এটি দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬.৩৫%, যা গত ২২ বছরে সর্বনিম্ন।
নতুন বিনিয়োগ স্থগিত রয়েছে, চালু থাকা কারখানার কিছু অংশও বন্ধ। সরকারি ব্যাংকের ঋণ কার্যক্রম সীমিত থাকায় উদ্যোক্তারা নতুন প্রকল্পে ঝুঁকি নিতে অনীহা দেখাচ্ছেন। ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, “উচ্চ সুদ এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে ঋণপ্রবাহ কমেছে। নির্বাচনের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বিনিয়োগও বাড়বে।”
মূল্যস্ফীতি ফের ঊর্ধ্বমুখী
সেপ্টেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আবার বেড়ে গেছে। সবজি ও কাঁচামরিচের দাম কেজিতে ১০–৩০০ টাকা পর্যন্ত বাড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসেব অনুযায়ী, সাধারণ মূল্যস্ফীতি ৮.৩৬%-এ পৌঁছেছে, আগস্টের ৮.২৯%-এর চেয়ে সামান্য বেশি। খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে ৭.৬৪%, খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দাম বেড়ে ৮.৯৮% হয়েছে।
কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, “বর্ষাকালের প্রভাব এবং সরবরাহ চেইনের সমস্যার কারণে দাম বেড়েছে। সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে পণ্য ভোক্তার হাতে পৌঁছানো দাম বৃদ্ধিকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে।”
ঋণের উচ্চ সুদ ব্যবসায়ীদের জন্য বাধা
বর্তমান ঋণের উচ্চ সুদ ব্যবসাবান্ধব নয় বলে মন্তব্য করেছেন উদ্যোক্তারা। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে বৈঠকে ব্যবসায়ীরা সুদের হার ধীরে ধীরে কমিয়ে এক অঙ্কে আনার অনুরোধ জানিয়েছেন। এফবিসিসিআই মহাসচিব আলমগীর বলেন, “ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা সাধারণত ১০–১১% মুনাফা করেন। ১৪%-এর বেশি সুদ বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যবসার জন্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে।”
শিল্প খাত সম্প্রসারণের ইঙ্গিত
চলতি বছরের আগস্টে পারচেজিং ম্যানেজারস ইনডেক্স (পিএমআই) সূচক কিছুটা কমলেও সেপ্টেম্বরের সূচক ৫৯.১-এ পৌঁছেছে। ৫০-এর ওপরে সূচক থাকলে খাত সম্প্রসারণশীল হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি দেখাচ্ছে, শিল্প খাত দ্রুত সম্প্রসারণের পথে ফিরেছে, কৃষি ও নির্মাণ খাতও সম্প্রসারণে রয়েছে। তবে সেবা খাত তুলনামূলক ধীর।
চলতি হিসাব ও প্রবাসী আয়: আশার আলো
রফতানি আয় ও প্রবাসী রেমিট্যান্সের ফলে চলতি হিসাবের উদ্বৃত্ত বেড়েছে। জুলাই–আগস্টে ৪৮৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের উদ্বৃত্ত রেকর্ড হয়েছে, আগের বছর একই সময়ে যা ছিল ১৯১ মিলিয়ন ডলার। রেমিট্যান্সের ১৮.৪%-এর প্রবৃদ্ধি সামগ্রিক বৈদেশিক খাতকে শক্ত অবস্থানে এনেছে।
ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে ঘাটতি মাত্র ৫৩ মিলিয়ন ডলারে নেমেছে, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে এটি ছিল ১.৪ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের শুরুতে বৈদেশিক খাত আগের চেয়ে স্থিতিশীল।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, প্রবাসী আয় বৃদ্ধি, রফতানি প্রবৃদ্ধি, নমনীয় বিনিময় হার এবং সরকারি রাজস্ব ও মুদ্রানীতির কৌশলগত কঠোরতা এই ইতিবাচক প্রবণতার মূল কারণ।