মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তেল ও তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) রপ্তানিতে সহায়তার অভিযোগে ৫০টির বেশি প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি ও জাহাজের বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনকারী এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কাতেও চালান পৌঁছেছে বলে জানানো হয়েছে।
মার্কিন অর্থ বিভাগের বিদেশী সম্পদ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (ওএফএসি) গত বৃহস্পতিবার এই পদক্ষেপের ঘোষণা দেয়। সংস্থাটি জানায়, ইরানের নগদ অর্থ প্রবাহ কমানো এবং সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত গোষ্ঠীর অর্থায়ন বন্ধ করার বৃহত্তর উদ্যোগের অংশ হিসেবে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা জাহাজ ও প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহার করে ইরানের এলপিজি দুটি চালান বাংলাদেশে পৌঁছেছে। পাশাপাশি, চলমান পরিবহন কার্যক্রমও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
ওএফএসি বলছে, এই নেটওয়ার্কের সহযোগিতায় ইরান বিলিয়ন ডলারের পেট্রোলিয়াম ও পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য রপ্তানি করছে, যা দেশের রাজস্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট বলেন, নতুন নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্য ইরানের জ্বালানি রপ্তানি ব্যবস্থা ভাঙা এবং এটি ওয়াশিংটনের ‘সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক চাপ’ নীতির অংশ।
নতুন নিষেধাজ্ঞার তালিকায় আছে সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক প্রতিষ্ঠান স্লোগাল এনার্জি ডিএমসিসি ও মারকান হোয়াইট ট্রেডিং ক্রুড অয়েল অ্যাবরোড কোম্পানি এলএলসি। ২০২৪ সাল থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় ইরানের এলপিজি চালান পাঠানোর অভিযোগ রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে। ওএফএসি জানায়, একাধিক চালান শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার ব্যবহারকারীদের কাছে পৌঁছেছে। মার্কিন অর্থ বিভাগের তথ্যমতে, ২০২৫ সালের শুরুতে পানামা পতাকাবাহী ‘GAS DIOR’ জাহাজ বাংলাদেশের জন্য ১৭ হাজার টনেরও বেশি ইরানি এলপিজি সরবরাহ করে। জাহাজটি পানামাভিত্তিক এরিলিন শিপিং ইনক.-এর মালিকানাধীন। এই প্রতিষ্ঠানকেও নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয়েছে।
২০২৪ সালের শেষ দিকে কোমোরোস পতাকাবাহী জাহাজ ‘Ada’ (আগে ‘Captain Nikolas’ নামে পরিচিত) বাংলাদেশে এলপিজি সরবরাহ করে। সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক সি শিপ ম্যানেজমেন্ট এলএলসি-এর মালিকানাধীন জাহাজটি সর্বশেষ মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় ‘অবরুদ্ধ সম্পদ’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। গত বছরের ১৩ অক্টোবর চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে ‘BLPG Sophia’ নামের একটি ছোট জাহাজে এলপিজি খালাসের সময় ‘Captain Nikolas’-এ আগুন ধরে যায়। প্রায় ৩৪ হাজার টন এলপিজি বহনকারী জাহাজটি আইনি জটিলতার কারণে কয়েক মাস আটকে ছিল। চলতি বছরের ৫ সেপ্টেম্বর জাহাজটিকে পুনরায় গ্যাস স্থানান্তরের অনুমতি দেওয়া হয়। ট্র্যাকিং তথ্য অনুযায়ী এটি এখনও চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করা অবস্থায় রয়েছে।
যদিও কোনো বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান বা সরকারি সংস্থার নাম নিষেধাজ্ঞার তালিকায় নেই, এসব চালানের উল্লেখ করে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশও ওয়াশিংটনের নজরদারি ও বাস্তবায়ন ব্যবস্থার আওতায় এসেছে। মার্কিন আইনে নিষিদ্ধ লেনদেনে জড়িত বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো ‘সেকেন্ডারি স্যাংশন’-এর ঝুঁকিতে থাকে, যার মধ্যে রয়েছে মার্কিন আর্থিক ব্যবস্থায় প্রবেশাধিকার হারানোর মতো পদক্ষেপ।
২০২৫ সালে এটি ইরানের তেল ক্রেতা ও মধ্যস্বত্বভোগীদের বিরুদ্ধে চতুর্থ দফা নিষেধাজ্ঞা। বিশেষ করে চীনভিত্তিক রিফাইনারিগুলোর বিরুদ্ধে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। মার্কিন অর্থ বিভাগ জানায়, সংযুক্ত আরব আমিরাত, হংকং ও মার্শাল দ্বীপপুঞ্জভিত্তিক কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ইরানি তেলের উৎস গোপন করতে ‘শ্যাডো ফ্লিট’ বা ছায়া নৌবহর ব্যবহার করত। এক জাহাজ থেকে অন্য জাহাজে তেল স্থানান্তর ও ছদ্ম কোম্পানির মাধ্যমে পণ্যের গতিপথ গোপন করার মতো কার্যক্রম এতে অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ওএফএসি জানিয়েছে, ইরানের তেল ও এলপিজি পরিবহন বা উৎস গোপনের কাজে ব্যবহৃত বহু জাহাজের নাম শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ম্যাক্স স্টার, গ্যাস ভিশন, সি অপেরা ও টিউলিপ। এসব জাহাজ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে শত শত মিলিয়ন ডলারের ইরানি জ্বালানি পণ্য পরিবহন করেছে। এই নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত চালানগুলো বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, চীন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতেও পৌঁছেছে।
চীনের শানডং জিনচেং পেট্রোকেমিক্যাল গ্রুপ ও রিজাও শিহুয়া ক্রুড অয়েল টার্মিনালও নতুন নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত। মার্কিন অর্থ বিভাগের অভিযোগ, ২০২৩ সাল থেকে তারা নিষিদ্ধ জাহাজ ব্যবহার করে কোটি কোটি ব্যারেল ইরানি অপরিশোধিত তেল আমদানি করেছে। এভাবে তারা ইরানের রাষ্ট্রায়ত্ত তেল বিপণন সংস্থাকে বিলিয়ন ডলারের তেল পরিবহন ও সংরক্ষণে সহায়তা করেছে।
নিষেধাজ্ঞার ফলে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সব মার্কিন সম্পদ অবরুদ্ধ হয়েছে। কোনো মার্কিন কোম্পানি বা নাগরিক তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে না। এই পদক্ষেপ দক্ষিণ এশিয়ার জ্বালানি বাজারে প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলো, যারা স্পট মার্কেট থেকে এলপিজি কিনে থাকে। ওএফএসি বলেছে, তাদের উদ্দেশ্য শাস্তি নয়, বরং আচরণে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা। বিশ্লেষকদের মতে, নিষেধাজ্ঞা ছোট আমদানিকারকদের জন্য জ্বালানি সরবরাহ জটিল করে তুলতে পারে।