বাংলাদেশের শিল্প ও উৎপাদন খাতে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান নাসির ফ্লোট গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ। দেশের নির্মাণ ও কাচ শিল্পে দীর্ঘদিন ধরে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন প্রয়াত নাসির উদ্দিন বিশ্বাস। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন তার সন্তান নাসিম বিশ্বাস। সম্প্রতি তিনি প্রতিষ্ঠানটির সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন।
নাসিম বিশ্বাস জানিয়েছেন, তারা ভ্যালু অ্যাডেড পণ্য নিয়ে কাজ করছেন। অ্যালুমিনিয়াম নিয়ে তারা নতুন প্রোডাক্ট লাইন শুরু করেছেন। ফরওয়ার্ড ও ব্যাকওয়ার্ড ইন্টিগ্রেটেড প্রোডাক্টেও তারা মনোযোগ দিচ্ছেন। এছাড়া ইলেকট্রিক ভেহিকল খাতেও তারা কাজ করছেন। নাসিম বিশ্বাসের লক্ষ্য নতুন কিছু করার চেষ্টা করা এবং শিল্পে উদ্ভাবন নিয়ে আসা।
ব্যবসার যাত্রা শুরু হয়েছিল বাবার সঙ্গে। নাসিম বিশ্বাস বলেন, “অবশ্যই বাবা তো বাবাই। ওনাকে অনেক ক্ষেত্রেই মিস করি। পারিবারিকভাবে ওনার অভাব সবসময় অনুভব করি। কাছের কেউ চলে গেলে কেমন লাগে, সেটা আগে বুঝতাম না। বাবা চলে গেলে সেই অনুভূতিটা উপলব্ধি করতে পারি।”
তিনি আরও বলেন, “বাবার সঙ্গে আমার পথচলা নাসির গ্লাসের প্রথম ইউনিট থেকে শুরু। ২০০৪ সালে আমরা যখন নির্মাণ কাজ করতাম, আমি তখন বিদেশে ছিলাম। ২০০৫-এ ফিরে আসার পর থেকে ওনার সঙ্গে কাজ করা। উনি চলে গেছেন ২০২২-এ। দীর্ঘ প্রায় ১৭-১৮ বছর একসঙ্গে কাজ করেছি। ব্যবসার নানা সমস্যা সমাধান, কৌশল গ্রহণ—সব ক্ষেত্রেই ওনার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, দূরদর্শী চিন্তা আজও মিস করি। তিন বছর হয়ে গেছে, কিন্তু অনেক পরিস্থিতিতে উপলব্ধি হয়, উনি থাকলে গল্পটা ভিন্ন হতো। যতই আমরা সামনে এগিয়েই যাই, বাবাকে মিস করা চলতেই থাকবে।”
প্রশ্ন: নাসির ফ্লোট গ্লাসের পণ্য নাসির সিনট্যাক্স অ্যালুমিনিয়াম। কাচের পাশাপাশি অ্যালুমিনিয়াম পণ্য বাজারে নিয়ে আসার গল্প ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাই।
নাসির সিনট্যাক্স অ্যালুমিনিয়াম—এটা আমাদের জন্য একটা নতুন উদ্যোগ। আমরা বুঝি যে কাচকে যেকোনো ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য ফ্রেমিংয়ের প্রয়োজন হয়। সেটা হোক বাইরের সম্মুখভাগ বা অভ্যন্তরীণ বিভাজন কাচ কখনই একা দাঁড়াতে পারে না। কাচের ফ্রেম বলেন, পেছনের ফাসাড বলেন—কোথাও না কোথাও অ্যালুমিনিয়ামের একটি অবদান থাকেই। বাবা থাকতেই এটি আমরা আলোচনা করেছিলাম। কিন্তু সবকিছু মিলিয়ে তখন হয়ে ওঠেনি।
বাবা চলে যাওয়ার পর উপলব্ধি করলাম অ্যালুমিনিয়ামে আমাদের যুক্ত হওয়া উচিত। কেননা এটি একই চ্যানেলে বিক্রি হয়। ক্রেতা ও ব্যবহারকারী একই। তাই আমরা চিন্তা করলাম যে এখানে আমাদের প্রবেশ করা উচিত। উদ্ভাবনের মাধ্যমে সমাধান নিয়ে আসা দরকার। এটিকে আরো আধুনিক রূপ দেয়া দরকার; ইন্টেরিয়র ডিজাইনের ক্ষেত্রে যে ধরনের ঘাটতি আছে, সে জায়গাটিকে পূর্ণতা দিতে আমরা মনে করি নাসির সিনট্যাক্স অ্যালুমিনিয়ামের প্রয়োজনীয়তা আছে।
প্রশ্ন: দেশে কাচ ও অ্যালুমিনিয়াম শিল্পের বাজারের আকার সম্পর্কে ধারণা দেয়া যায় কি?
এ মুহূর্তে মাসের হিসাবে কাচের বাজার ২৬ হাজার টন। সেই হিসাবে বার্ষিক বাজার প্রায় ৩ লাখ টন। অন্যদিকে অ্যালুমিনিয়াম তুলনামূলক কম ভারী পণ্য, বর্তমানে অ্যালুমিনিয়ামের মাসিক বাজার চার হাজার টন। সেই হিসাবে বছরে প্রায় ৫০ হাজার টন।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে কাচ শিল্পের সূচনা এবং পথচলায় আপনার বাবার একটি বড় অবদান আছে, এ ইতিহাস সম্পর্কে যদি বলতেন।
আমার বাবা খুবই দূরদর্শী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি এ দেশের আইকনিক পাইওনিয়ার। তিনি সব সময় নতুন কিছু করতে অভ্যস্ত ছিলেন। ২০০৪ সালে যখন আমরা নাসির গ্লাসের প্রথম ইউনিট শুরু করি তখন ব্যাংক, আর্থিক খাত বা ব্যবসায়ীদের কাচ প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা ছিল না। ওই সময় ব্যাংককে আমাদের বোঝাতে অনেক কষ্ট হয়েছে যে বাংলাদেশে স্থানীয় উৎসের সিলিকা স্যান্ড থেকে বিশ্বমানের কোনো পণ্য তৈরি করা সম্ভব। তখনকার পরিপ্রেক্ষিতে এটি ভবিষ্যতের জন্য বড় একটি সিদ্ধান্ত ছিল। আমরা এ শিল্পে ২০০৫ সালে উৎপাদনে আসি। ২০২৪ বা ২০২৫ সালে এসে আমরা দ্বিতীয় বড় কোনো উৎপাদককে দেখছি। সেজন্য বলতে চাই, তিনি ২০ বছর আগে এ দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে এ দেশে কাচ শিল্প হতে পারে। তখন আমরা কাচে পুরোপুরি আমদানিনির্ভর ছিলাম।
আমাদের প্রথম ফ্যাক্টরি ছিল ৪০০ টনের। পরে দ্বিতীয় লাইন করি, যেটির উৎপাদন ৬০০ টন। দুটি মিলিয়ে এখন প্রতিদিন আমাদের উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার টন কাচ। নাসির গ্রুপের অধীনে একত্রে বাজারের প্রায় ৭০ শতাংশ মার্কেট শেয়ার আমাদের। এটি একটি বড় দূরদর্শী সিদ্ধান্তের উদাহরণ। তিনি সবসময় নতুন জিনিস নিয়ে চিন্তা করতেন। বাংলাদেশে মেলামাইন কিংবা জাম্প কেডস সেই সময়কার খুবই চমকপ্রদ পণ্য ছিল। কাচ উৎপাদন শুরুর পর তিনি আরো অনেক কোম্পানি করেছেন, যেগুলো দেশের প্রথম পণ্য ছিল। নতুন জিনিসের প্রতি তার সবসময় আগ্রহ ছিল। সবসময় বড় ঝুঁকি নিতে পছন্দ করতেন। আগে বাংলাদেশ মূলত আমদানিনির্ভর ছিল, কিন্তু বর্তমানে বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয়ভাবে কাচ উৎপাদন করছে। ফলে আমদানিনির্ভরতা কমেছে। সব বিবেচনায় নির্মাণ খাতে ব্যয় সাশ্রয়ে এ শিল্পের ভূমিকা কেমন?
নির্মাণ খাতের ব্যয় কমাতে কাচ সবসময় অবদান রেখে চলেছে। অবকাঠামো উন্নয়নে অভ্যন্তরীণ পার্টিশনে ইট দিতে গেলে ইটের খরচ, সিমেন্টের খরচ, শ্রমিকের খরচ, কালার ফিনিশিংয়ের জন্য রঙের খরচ, আবার রঙের শ্রমিকের জন্য খরচ করতে হচ্ছে। এখানে উপাদানও বেশি লাগছে। আমরা এখন অফিসগুলোতে দেখছি বড় ইটের দেয়াল আর নেই। সব জায়গায়ই কাচের দেয়াল তৈরি হচ্ছে। অটোফ্রস্ট (স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঝাপসা হওয়া আবরণ) কাচের মাধ্যমে নিজের গোপনীয়তাও রক্ষা করা যাচ্ছে। বাণিজ্যিক কর্মস্থলে ইটের বিকল্প হিসেবে কাচ চলে এসেছে। কাচের ব্যবহারে খরচ কমেছে। পাশাপাশি এটি খুলে অন্যত্র নিয়েও যাওয়া যাচ্ছে। পুনঃস্থাপনেও এটি মূল্যসাশ্রয়ী।
প্রশ্ন: কাচ কি সব শ্রেণী-পেশার মানুষের জন্য ব্যবহার উপযোগী?
কাচের ব্যবহার বাড়ছে। প্রতি বছর এ মার্কেটের প্রবৃদ্ধি ১০-১৫ শতাংশ। আমাদের গবেষণা বলছে, এ প্রবৃদ্ধি শুধু শহরেই নয়, গ্রামাঞ্চলেও বাড়ছে। এখন উপজেলা পর্যায়েও কিন্তু টিনের বাড়ির সংখ্যা কমে এসেছে। ইটের পাকা বাড়ি তৈরি হচ্ছে। আর পাকা বাড়িতে অনেকে কাচের জানালা ব্যবহার করছেন। আগের কাঠের দরজা-জানালার বিকল্প হয়ে উঠেছে কাচ। কাঠের ব্যবহার কমে আসা মানে এ শিল্প সবুজ পরিবেশ রক্ষা করছে। সুরক্ষার দিক দিয়ে মানুষ ভেতরে একটি গ্রিল লাগিয়ে নিচ্ছে। বাইরে অ্যালুমিনিয়ামের প্রোফাইল স্লাইডিং হচ্ছে। সেজন্য নিরাপত্তা ও সুরক্ষার ইস্যুতেও একটি সমাধান দিচ্ছে। কাঠের দরজা লাগালে কয়েক বছর পর এটির রং নষ্ট হচ্ছে, ঘুণ ধরে, পোকা লেগে নষ্ট হবে। কিন্তু কাচ ও অ্যালুমিনিয়াম একবার লাগালে ৩০-৪০ বা ৫০ বছর আর কোনো চিন্তা নেই।
প্রশ্ন: সরাসরি উৎপাদন খাতে এবং পরোক্ষভাবে নির্মাণ ও রিয়েল এস্টেট খাতে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরির ক্ষেত্রে কাচ শিল্পের ভূমিকা কেমন? এ প্রেক্ষাপটে দক্ষ কর্মীর জোগান সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
কাচ শিল্পে দক্ষ লোকবলের ঘাটতি আছে। কারণ সরকারের পক্ষ থেকে যেসব পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট তৈরি হয়েছে সেখানে কাচ ও অ্যালুমিনিয়াম এবং অ্যালুমিনিয়াম ফ্যাব্রিকেশন, কাচ ফ্যাব্রিকেশন নিয়ে কোনো কোর্স এখনো ডেভেলপ করা হয়নি। কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আমরা কোনো দক্ষ লোকবল পাচ্ছি না। যেটি কাঠ, মোটর মেকানিকস, সিভিল, লেদার অ্যান্ড ট্যানারি, গার্মেন্টস, টেক্সটাইলের মতো অন্যান্য খাতে পাচ্ছি। এখানে আমরা নিজেরাই শ্রমিককে দক্ষ করি। ২০০৪-০৫ সালে আমরা যখন কাচ কারখানা করি তখন কোনো টেকনিশিয়ান ছিল না। এ বিষয়ে জানে এমন লোকও ছিল না। তারপর প্রথম কর্মী থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত যতজন এসেছে, সবাইকে আমরা প্রশিক্ষণ দিয়েছি। শুরুর দিকে আমরা বিদেশী কর্মী নিয়ে এসেছি, এরপর তাদের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত করেছি।
আমরা যদি কাচ বসানো, স্থাপন বা দেখভালের পর্যায়ে আসি, সেক্ষেত্রে এর একটি ন্যূনতম ভিত্তি ছিল। সময় যত এগিয়েছে ইন্টারনেট, ইউটিউবসহ নতুন প্রযুক্তিতে আমাদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি হয়েছে। ইন্টেরিয়রের ক্ষেত্রে স্থপতিদের সঙ্গে আমরা নিবিড়ভাবে কাজ করি। তাদের নতুন পণ্য ও এর ব্যবহার প্রক্রিয়া বোঝাই। এখান থেকে কর্মীরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে হয়তো উন্নত হচ্ছে না, তবে অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে একটি দক্ষতা উন্নয়ন হচ্ছে। ইন্টেরিয়রের ক্ষেত্রে এ কর্মীদের সম্পৃক্ততা ও সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কাচের ব্যবহার যত বাড়ছে, এটির স্থাপন জনবলও বাড়ছে। এখানে কর্মসংস্থান বাড়ছে। পরিবহন জনবলও বাড়ছে। সেজন্য বলব, এ শিল্পের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কর্মসংস্থানও বাড়ছে।
প্রশ্ন: বিশ্বব্যাপী এখন পরিবেশবান্ধব বা গ্রিন ম্যানুফ্যাকচারিং নিয়ে গুরুত্ব বাড়ছে। টেকসই উৎপাদন পদ্ধতি নিয়ে আপনার কর্মপরিকল্পনা কী? ভবিষ্যতে পরিবেশ সুরক্ষায় কী ধরনের পরিকল্পনা রয়েছে?
গ্রিন (পরিবেশবান্ধব) আমাদের ভবিষ্যৎ। এখানে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ‘তিন শূন্য’ তত্ত্বের কথা উল্লেখ করতে হয়। এটি আমাদেরও লক্ষ্য। গ্রিনের দিক থেকে আমাদের কোম্পানি অনেক এগিয়ে। উৎপাদনের সময় যে তাপ বা ওয়েস্ট হিট (অপব্যয়িত তাপ) বের হয়, তার অধিকাংশই টারবাইন দিয়ে পুনর্ব্যবহারে আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন করি। তাপকে বায়ুতে ছেড়ে না দিয়ে দুই মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছি; এটি আমাদের মূল প্রবাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আমরা এটি ২০১০ সাল থেকে করছি। এজন্য আবারো আমার বাবার দূরদর্শী চিন্তার কথা উল্লেখ করতে হয়। কারণ তখন এ বিষয়ে সরকারের কোনো বিধি বা রেগুলেশন ছিল না। আমাদের সব প্রকল্পেই ‘ওয়েস্ট হিট প্রোগ্রাম’ আছে, যেখান থেকে ১-২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পুনর্ব্যবহার করি। একই সঙ্গে ফ্যাক্টরির ছাদে সোলার প্যানেল স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, যেগুলো এরই মধ্যে স্থাপন প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে।
প্রশ্ন: গত দুই দশকে কাচ ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরে উৎপাদন প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে কী কী পরিবর্তন এসেছে এবং এগুলো শিল্পের দক্ষতা কতটা বাড়িয়েছে?
এখানে বড় কোনো পরিবর্তন হয়নি। আমরা যখন শুরু করি, ওইটিই ছিল বড় রূপান্তর। এখন ফ্লোট কাচ তৈরি হচ্ছে। ডলোমাইট, লাইমস্টোন ও সোডা অ্যাশ একসঙ্গে মেশানো হয়, তারপর খুব উচ্চ তাপমাত্রায় গলানো হয়। এরপর এ গলিত কাচকে গলিত টিনের ওপর পরিচালনা করা হয়। টিনের ওপর তরল কাচ ভাসে। এজন্য একে ফ্লোট কাচ বলা হয়। এর আগে যে প্রযুক্তি ছিল সেটি ছিল ভার্টিকাল সিস্টেম, যা শিট কাচ নামে পরিচিত। আগে আমাদের দেশের দুটি ছোট কোম্পানি শিট কাচ প্রযুক্তিতে পণ্য তৈরি করত। এরপর ফ্লোট কাচ প্রযুক্তি আসে। আমরা যখন শুরু করি, তখন এ প্রযুক্তিই ব্যবহার করি।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে কাচ ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে প্রতিযোগিতার পরিবেশ বর্তমানে কেমন? এখানে রেগুলেটরদের কিছু করার আছে কি?
কাচ শিল্প বর্তমানে চাহিদার চেয়ে বেশি সরবরাহ করছে। এ কারণে যে নতুন উৎপাদকরা এ খাতে এসেছেন, তাদের সরবরাহ করা পণ্য এ মুহূর্তে সম্পূর্ণ বিক্রয়যোগ্য নয়। কারণ কাচ উৎপাদন এমন একটি প্রক্রিয়া, যা থামানো যায় না। একবার ফার্নেসে আগুন জ্বালালে এটিকে টানা ১০-১১ বছর বিরামহীনভাবে চালাতে হবে। থামালে পুনরায় তৈরি করতে সময় ও খরচ বেশি হবে। এ মুহূর্তে চাহিদার চেয়ে আমাদের কাচ উৎপাদন বেশি। সামনে আরো নতুন উৎপাদক আসার সম্ভাবনা আছে। এটি শিল্পে বিভাজন সৃষ্টি করবে। উন্মুক্ত অর্থনীতিতে কোনো বাধা দেয়া যায় না। ফাইন্যান্সাররা মূল্যায়ন করতে পারেন। নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে এটি থামানো কঠিন।
প্রশ্ন: কাচ রফতানির সম্ভাবনা ও রফতানির বাজার সম্পর্কে জানতে চাই।
রফতানির সম্ভাবনা আছে। কিন্তু আমরা যে পণ্যই রফতানি করি না কেন, মূল প্রতিযোগী চীন। সেজন্য চীনের উৎপাদন খরচের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা কঠিন। আমাদের দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খরচ বেশি। কাচ মানে গ্যাসভিত্তিক ফার্নেস। এটি অয়েল বা কোলবেজড করলে খরচ কমবে না।
গ্যাসের খরচ উৎপাদনের ২৫-৩০ শতাংশ। চীনে উৎপাদন খরচ অনেক কম। সোডা অ্যাশও চীনে স্থানীয়ভাবে পাওয়া যায়। আমরা যদি রফতানির জন্য শুল্কমুক্ত আমদানির চিন্তাও করি, পরিবহন ও জ্বালানির খরচ বাড়ে। এছাড়া ব্যাংক সুদও চীনের তুলনায় বেশি। তাই চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা চ্যালেঞ্জিং। আমরা গত চার-পাঁচ বছর ভারতের বাজারে রফতানি করছি। আফ্রিকা ও ইউরোপেও কিছু রফতানি করেছি, কিন্তু তা সীমিত। ভারতই একমাত্র দেশ যেখানে নিয়মিত রফতানি হচ্ছে। আফ্রিকা সম্ভাবনাময়, তবে চীনের কারণে চ্যালেঞ্জ বেশি।
প্রশ্ন: কাচ খাতের সম্ভাবনার বিকাশে সরকারের কোন পদক্ষেপগুলো ব্যবসার জন্য সহায়ক হতে পারে?
সরকার সবসময় সহযোগিতা করছে। তবে গ্যাস সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন হওয়া প্রয়োজন। গ্যাসের চাপ ঠিক না থাকলে উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া মূল উপাদান সিলিকা স্যান্ড সংগ্রহে সম্প্রতি কিছু সমস্যা হচ্ছে। সরকারের সঙ্গে সমঝোতা প্রয়োজন। সিলিকা স্যান্ড পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয়। এটি ৯১ শতাংশ সিলিকা, যা কৃষিজমিকে কোনো ক্ষতি করে না। সেজন্য এ শিল্পের জন্য সিলিকা স্যান্ডের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা জরুরি।
প্রশ্ন: নতুন কোন খাতে আপনাদের ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাই।
আমরা ভ্যালু অ্যাডেড পণ্য নিয়ে কাজ করছি। অ্যালুমিনিয়াম নিয়ে এসেছি। এর ফরওয়ার্ড ও ব্যাকওয়ার্ড ইন্টিগ্রেটেড প্রডাক্ট নিয়ে কাজ করব। ইলেকট্রিক ভেহিকল নিয়ে কাজ করছি। আমাদের গ্রুপের লক্ষ্য নতুন কিছু করার চেষ্টা করা।
প্রশ্ন: এতক্ষণের কথাবার্তার বাইরে গুরুত্বপূর্ণ এমন কিছু আছে কি যা আপনি বলতে চান?
স্থাপত্যবিদ কমিউনিটিকে বলতে চাই, বাংলাদেশ এখন কাচ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সেজন্য তারা যেন বিদেশী কাচের দিকে না ঝুঁকে পড়েন। আমরা এখনো দেখছি কিছু স্পেশালাইজড প্রকল্পে আমদানীকৃত কাচ আসে। দেশে ভ্যালু অ্যাডেড পণ্য থাকার পরও বিদেশ থেকে আনার প্রবণতা রয়ে গেছে। আমরা তাদের বলব, দেশী পণ্য ব্যবহার করুন। দেশীয় শিল্প ও দেশের অর্থনীতিকে বাঁচান।
সূত্র: নাসিম বিশ্বাস, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, নাসির ফ্লোট গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ। বনিক বার্তা