চট্টগ্রামের মিরসরাই ও বাগেরহাটের মোংলায় পরিকল্পিত ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইকোনমিক জোন) প্রকল্পটি বাতিল করেছে বাংলাদেশ সরকার। দীর্ঘ বছর ধরে কোনো কার্যকর অগ্রগতি না হওয়া এবং ভারতের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় প্রতিক্রিয়ার অভাবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)-এর নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বলেন, “ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চলকে এখন জিটুজি (সরকার-টু-সরকার) কাঠামো থেকে সরানো হয়েছে। প্রকল্পটি মূলত প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল, জমি চিহ্নিত করা হয়েছিল এবং সম্ভাব্য ঠিকাদারদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছিল, কিন্তু চূড়ান্ত কোনো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি।”
তিনি আরও জানান, “মিরসরাইয়ে ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের জন্য প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু কোনো কার্যকর অগ্রগতি হয়নি। প্রকল্পের মেয়াদ জুনে শেষ হয়েছে এবং ভারত থেকে যে লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) তহবিল বরাদ্দ করা হয়েছিল, তা বাতিল করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এই জমি অন্য কাজে ব্যবহার করা হতে পারে, তবে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।”
প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ একাধিকবার ভারতকে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান ও অনুমতির চিঠি পাঠিয়েছিল, কিন্তু সাড়া আসেনি। এর ফলে কার্যকরভাবে প্রকল্পটি বাতিল হয়ে গেছে।
২০১৫ সালে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকের (এমওইউ) আওতায় মিরসরাইয়ে ৯০০ একর এবং মোংলায় ১১০ একর জমিতে এই দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ২০১৯ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) মিরসরাই প্রকল্পটি অনুমোদন করেছিল, যেখানে ভূমি উন্নয়ন, সংযোগ সড়ক, প্রশাসনিক ভবন এবং সেবা অবকাঠামো নির্মাণের জন্য প্রায় ৯৬৫ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল। এর মধ্যে ৯১৫ কোটি টাকা ভারত থেকে এলওসি-এর মাধ্যমে আসার কথা ছিল।
তবে প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি শূন্যের কোঠায়। বেজার তথ্য অনুযায়ী, প্রকল্প শুরুর পর ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত মাত্র ৬ কোটি ৩ লাখ টাকা খরচ হয়েছে, যা মোট ব্যয়ের মাত্র ১%। এর মধ্যে সরকারি অর্থ ছিল ৩ কোটি ৪৮ লাখ এবং প্রকল্প সহায়তা থেকে ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।
ভারতের এলওসি শর্ত অনুযায়ী ভূমি উন্নয়নের কাজ শুধুমাত্র ভারতীয় ঠিকাদারদের মাধ্যমে করতে হবে এবং ৬৫ শতাংশ সরঞ্জাম ভারতের বাজার থেকে আমদানি করতে হবে। এ কারণে দরপত্র আহ্বানেও কোনো প্রতিষ্ঠান আগ্রহ দেখায়নি। ২০২২ সালে আদানি পোর্টস অ্যান্ড এসইজেড লিমিটেডের সঙ্গে একটি খসড়া চুক্তি (টার্ম শিট) হলেও চূড়ান্ত ডেভেলপার চুক্তি সম্পন্ন হয়নি।
২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত ভারত–বাংলাদেশ যৌথ কার্যকরী দলের বৈঠকে বাংলাদেশ পুনরায় দরপত্রে বাংলাদেশি ঠিকাদারদেরও অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু ভারত সে প্রস্তাবে রাজি হয়নি।
প্রকল্পের সাবেক পরিচালক ও বিডার নির্বাহী সদস্য মো. মোখলেসুর রহমান বলেন, “বাংলাদেশ তার সব দায়িত্ব পালন করেছে, কিন্তু ভারতের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। কোনো ভারতীয় ঠিকাদার ভূমি উন্নয়নে আগ্রহ দেখায়নি। এমন পরিস্থিতিতে প্রকল্প চালানো সম্ভব হয়নি।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকল্পের ব্যর্থতার মূল কারণ ছিল ভারতের এলওসি–এর শর্ত, যেখানে বাংলাদেশি ঠিকাদারের অংশগ্রহণ সীমিত ছিল, আর ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোরও আগ্রহ ছিল না।
যদিও এই প্রকল্প বাতিল হয়েছে, তবুও বাংলাদেশের অন্যান্য অর্থনৈতিক অঞ্চলে ভারতীয় বিনিয়োগ চলমান আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলো হলো: এশিয়ান পেইন্টস লিমিটেড (২৬ মিলিয়ন ডলার), রামকি এনভায়রো প্রাইভেট লিমিটেড (১০ মিলিয়ন ডলার), ম্যারিকো বাংলাদেশ লিমিটেড (২৬.৭২ মিলিয়ন ডলার) এবং সাকাটা ইনক্স প্রাইভেট লিমিটেড (২.১৩ মিলিয়ন ডলার)।