বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরেই দারিদ্র্য কমাতে অনেকটাই সফল হয়েছে। পাঁচ দশকের সংগ্রামের ফলস্বরূপ, স্বাধীনতার পর থেকে দারিদ্র্যের হার ক্রমশ কমে এসেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই ছন্দপতন লক্ষ্য করা গেছে। কোভিড মহামারির পর অর্থনীতি ধীরগতিতে চলতে থাকায়, আবার দারিদ্র্য বাড়তে শুরু করেছে। উচ্চমূল্যস্ফীতি মানুষের আয় কমিয়ে দিয়েছে, আর দেশের অনেক মানুষ পুনরায় দারিদ্র্যসীমার নিচে নামতে বাধ্য হয়েছেন।
দেশের বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান পরিস্থিতিও উদ্বেগজনক। কিছু বছর ধরেই দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ ও শিল্পখাতে কর্মসংস্থানের বৃদ্ধি থমকে গেছে। নতুন চাকরির সুযোগ কমে যাওয়ায় তরুণ প্রজন্ম ও কাজপ্রত্যাশীদের অবস্থা আরও সংকটময় হয়েছে।
একটি সাধারণ মানুষের কষ্টের গল্প
আশকোনা এলাকার আবদুস সালাম সেলুনে কাজ করেন। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে তিনি একটি ছোট ভাড়া ফ্ল্যাটে থাকেন। মাসিক সংসার খরচ এখন ২৫–৩০ হাজার টাকার মধ্যে। এক বছর আগেও তিনি ২০–২৫ হাজার টাকায় সংসার চালাতে পারতেন। কিন্তু বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন প্রতিটি মাসই তার জন্য কঠিন হয়ে উঠেছে। অবশেষে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, স্ত্রী ও সন্তানদের কুষ্টিয়ার গ্রামের বাড়ি পাঠাবেন, আর নিজে একটি মেসে থাকবেন। আবদুস সালাম জানিয়েছেন, “কয়েক মাস ধরে ধার করতে হয়েছে। এখন আর সামলাতে পারছি না, তাই পরিবারের নিরাপত্তার জন্য এই সিদ্ধান্ত নিতে হলো।”
আবদুস সালামের মতো সীমিত আয়ের অসংখ্য মানুষ এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। শুধু গরিব নয়, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তও এখন জীবনযাত্রা চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন।
দারিদ্র্য বেড়েছে কতটা?
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশের দারিদ্র্যের হার ছিল ১৮.৭ শতাংশ। সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিপিআরসি ২০২৫ সালের মধ্যে দেশে দারিদ্র্যের হার প্রায় ২৮ শতাংশের কাছাকাছি বলে জানিয়েছে। এছাড়া ১৮ শতাংশ মানুষ যেকোনো সময় দারিদ্র্যসীমার নিচে নামতে পারে। অর্থাৎ প্রতি চার জন মানুষের মধ্যে একজন দরিদ্র।
বিশ্বব্যাংকও তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের দারিদ্র্যের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১.২ শতাংশে। এ তথ্যগুলো স্পষ্টভাবে দেখাচ্ছে, দারিদ্র্য পুনরায় বাড়ছে।
দারিদ্র্য বৃদ্ধির কারণ
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে দারিদ্র্য বৃদ্ধির মূল তিনটি কারণ রয়েছে।
১. বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, কিন্তু মানুষের আয়ের বৃদ্ধির হার তা ছাড়িয়ে গেছে। ফলে জীবনযাত্রার মান কমে যাচ্ছে।
২. চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান তৈরি হয়নি; বরং কমেছে। বিশেষ করে শিল্প খাতে নিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়নি।
৩. কোভিড পরবর্তী সময়ে কৃষিখাতে ন্যূনতম মজুরিতে কাজ বেড়েছে, যা দারিদ্র্য হ্রাসে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক রুশিদান ইসলাম রহমান বলেন, শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় দারিদ্র্য হ্রাসের সম্ভাবনা কমে গেছে। পাশাপাশি, শ্রমবাজারের বেশিরভাগ পেশায় প্রকৃত মজুরি কমেছে।
অর্ধেক শিক্ষিত বেকার
দেশে শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্ব অনেক বেশি। সরকারি জরিপ অনুযায়ী, স্নাতক ডিগ্রিধারীর মধ্যে ১৩.৫ শতাংশ বেকার। উচ্চমাধ্যমিক পাস বেকারের হার ৭.১৩ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি পাঁচ শিক্ষিত মানুষের মধ্যে একজন চাকরিহীন।
ফাহিম ইবনে আহসান, ২০২২ সালে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন, আড়াই বছর ধরে পছন্দের চাকরি পাচ্ছেন না। সাম্প্রতিক একটি চাকরি ছেড়ে দিতে হয়েছে নিয়মিত বেতন না পাওয়ায়। তিনি বলেন, “পরিবারের পাঠানো টাকা দিয়েই চলতে হচ্ছে। চাকরির সুযোগ এখনও সেভাবে নেই।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষার মান ও পাঠ্যক্রম আধুনিক চাহিদার সঙ্গে মিলছে না। প্রযুক্তি ও দক্ষতার অভাব এবং প্রাসঙ্গিক শিক্ষার ঘাটতি বেকারত্ব বাড়াচ্ছে।
পাঁচ দশকের অর্জন: এখন বিপদের মুখে
স্বাধীনতার পর ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে দেশের অর্ধেক মানুষ হতদরিদ্র। ২০০০ সালের পর বিভিন্ন দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির মাধ্যমে ধীরে ধীরে দারিদ্র্যের হার কমে আসে, ২০২২ সালে তা ১৮.৭ শতাংশে নামে আসে। কিন্তু বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৭৩-৭৪ সালে দেশের সর্বোচ্চ ধনী ১০ শতাংশের হাতে মোট আয়ের ২৮.৫ শতাংশ থাকলেও, ২০২২ সালে তা বেড়ে ৪১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশের আয় ৩ শতাংশ থেকে কমে ১.৩১ শতাংশে নেমেছে। গিনি সহগ ০.৪৯–এ পৌঁছেছে, যা উচ্চ বৈষম্যের দিক ইঙ্গিত করছে।
বাংলাদেশের এই প্রাপ্তি এখন ঝুঁকির মধ্যে। দীর্ঘ সংগ্রামের পর অর্জিত দারিদ্র্য বিমোচন, বৈষম্য হ্রাস ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। সঠিক নীতি ও কার্যকর সমাধান ছাড়া এই ধারা চলতে থাকলে আরও বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নামবে।