গত বছর বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেল আমদানিকারক দেশ ভারত রাশিয়া থেকে ৫২.৭ বিলিয়ন ডলারের অপরিশোধিত তেল কিনেছে। এটি দেশের মোট তেল খরচের প্রায় ৩৭ শতাংশ। অর্থাৎ, ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তা এখন রাশিয়ার তেলের ওপরও কিছুটা নির্ভরশীল।
তবে এই সরল হিসাবের পেছনে এখন খেলা হচ্ছে কূটনৈতিক চাপের। চলতি বছরের আগস্টে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের পণ্য আমদানির ওপর ৫০ শতাংশ শুল্কারোপের হুঁশিয়ারি দিয়েছে, কারণ তারা মনে করছে ভারত রাশিয়ার তেল কেনা চালিয়ে যাচ্ছে। এরপর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ব্যক্তিগতভাবে একটি চুক্তি করেছেন, যার মাধ্যমে শীঘ্রই এই তেল কেনা বন্ধ হবে। পরের দিন রাশিয়ার পক্ষ সতর্ক মন্তব্য করে, আর ভারত এই বিষয় থেকে নিজেকে দূরে রাখে।
রাশিয়ার তেল: ভারতের জন্য লাভজনক, কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ
দিল্লিতে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ডেনিস আলিপভ বলেন, “রাশিয়ার তেল ভারতের অর্থনীতি ও জনগণের কল্যাণের জন্য লাভজনক।” ভারত সরকারও জানিয়েছে, তাদের তেল আমদানি নীতি উচ্চ অস্থির জ্বালানি বাজারে ভোক্তাদের স্বার্থ অনুযায়ী নির্ধারিত হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি নীতি এখন এক ধরনের ভারসাম্যের খেলা। মস্কোর সঙ্গে পুরোনো বন্ধুত্ব এবং ওয়াশিংটন থেকে ক্রমাগত চাপ—এই দুইয়ের মাঝে ভারতকে সঠিক সমাধান বের করতে হবে।
রাশিয়ার তেল কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
২০২১-২২ থেকে ২০২৪-২৫ সালের মধ্যে ভারতের রাশিয়ার অপরিশোধিত তেলের আমদানি ৪ মিলিয়ন টন থেকে ৮৭ মিলিয়ন টনে বৃদ্ধি পেয়েছে। মূল কারণ রাশিয়ার দেওয়া বড় ছাড় এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে তুলনামূলকভাবে কম দামে তেল পাওয়া। এই ছাড় ভারতের রিফাইনারদের জন্য অত্যন্ত উপযোগী।
গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের দিল্লিভিত্তিক বিশ্লেষক পার্থ মুখোপাধ্যায় বলেন, “রাশিয়ার তেলের আমদানি বাড়ার ফলে অন্য অনেক দেশের সরবরাহ কমেছে। ভারত এই সাশ্রয়কে কাজে লাগাচ্ছে, যার ফলে মোট আমদানি খরচের ৩-৪ শতাংশ বা প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হয়েছে।”
যুক্তরাষ্ট্রের চাপ বনাম বাজার সুবিধা
তবে শুধু সাশ্রয় নয়, যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ভারতকে নানাভাবে বিবেচনায় বাধ্য করছে। সাবেক ভারতীয় বাণিজ্য কর্মকর্তা অজয় শ্রীবাস্তব বলেন, “ভারতের শোধনাগারগুলো রাশিয়ার ভারী ইউরাল তেলের জন্য মানানসই। মার্কিন শেল তেল ব্যবহার করতে গেলে ব্যয়বহুল পুনর্বিন্যাস দরকার হবে, আর জেট ফুয়েল ও ডিজেলের উৎপাদন কমে যেতে পারে।”
ভারত এখন দুই পথে চিন্তা করছে:
- রাশিয়ার ছাড়প্রাপ্ত তেল কিনে স্বল্পমেয়াদি সাশ্রয় করা, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি নেওয়া।
- মধ্যপ্রাচ্য বা আমেরিকার ব্যয়বহুল তেল ব্যবহার করা, যার ফলে দেশীয় জ্বালানির দাম বাড়বে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, চলতি বছর তেলের দাম বাজারে ৭৮ ডলার থেকে ৫৯ ডলার পর্যন্ত কমেছে। অর্থাৎ বাজারের ওঠা-নামা এই সিদ্ধান্তের তুলনায় অনেক বেশি প্রভাব ফেলবে।
ভারতের জ্বালানি নীতি এখন সূক্ষ্ম ভারসাম্যের খেলা
দীর্ঘমেয়াদি খরচ বনাম স্বল্পমেয়াদি সাশ্রয়ের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা ভারতকে এক সূক্ষ্ম কৌশলী খেলার মধ্যে দাঁড় করিয়েছে। রাশিয়ার তেল থেকে অল্প সাশ্রয় করা না করলে মধ্যপ্রাচ্য ও মার্কিন তেল ব্যবহার করে দেশীয় জ্বালানির দাম বৃদ্ধি পেতে পারে। অন্যদিকে, রাশিয়ার তেল বন্ধ করলে বাজারে দাম বাড়বে, যা শুধু ভারতের নয়, গোটা বিশ্বের তেলের আমদানির খরচ বাড়াবে।
ভারত-আমেরিকার সম্পর্কের পরবর্তী অধ্যায়ও এই জ্বালানি নীতি ও সাশ্রয়-ঝুঁকির ভারসাম্যের ওপর অনেকটাই নির্ভর করছে।