আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটগ্রহণের জন্য প্রায় ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
‘দেশের বাইরে ভোটদান সিস্টেম উন্নয়ন ও বাস্তবায়ন’ শিরোনামে চলতি অর্থবছরে একটি নতুন প্রকল্প নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গত সেপ্টেম্বরে এই প্রকল্পের জন্য তহবিল চেয়ে চিঠি পাঠায় ইসি, যার পরিপ্রেক্ষিতেই অর্থ মন্ত্রণালয় অনুমোদন দেয়।
১২ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে অর্থ বরাদ্দের চিঠি ইসিকে পাঠায় মন্ত্রণালয়।
নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তারা জানান, সেপ্টেম্বরের শুরুতেই তহবিল চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু মাসের শেষ দিকে অন্তর্বর্তী সরকার প্রবাসী বাংলাদেশিদের আসন্ন নির্বাচনে ভোটাধিকার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরই অনুমোদনের প্রক্রিয়া দ্রুত এগোয়।
প্রথম ধাপে সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) ও যুক্তরাজ্যে পরীক্ষামূলকভাবে ভোট কার্যক্রম চালু করা হবে।
দূতাবাসভিত্তিক বুথে ভোটগ্রহণের পরিকল্পনা রয়েছে। প্রবাসীরা আগে অনলাইনে নিবন্ধন করবেন, এরপর নির্ধারিত দিনে পাসপোর্ট ও এনআইডি যাচাই করে ভোট দিতে পারবেন।
ইসি সচিব আখতার আহমেদ জানান, এখন পর্যন্ত ১১টি দেশে এনআইডি সেবা চালু হয়েছে। আগামী নির্বাচনের আগে আরও ৮টি দেশে এই সেবা চালুর প্রস্তুতি চলছে।
তিনি বলেন, “প্রবাসীদের জন্য একটি নিবন্ধন অ্যাপ তৈরি করা হয়েছে, যা অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে বা নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে চালু হবে। নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে নিবন্ধন চলছে, শিগগিরই মিয়ামি ও লস অ্যাঞ্জেলেসেও শুরু হবে।”
ইসি ওমান, দক্ষিণ আফ্রিকা, মালদ্বীপ ও জর্ডানে কারিগরি দল পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। এছাড়া বাহরাইন, সিঙ্গাপুর, ফ্রান্স ও স্পেনে এই উদ্যোগের অনুমতি দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
ইসি ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, প্রবাসীদের ভোটাধিকার দীর্ঘদিনের দাবি হলেও তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। একমাত্র প্রচলিত পোস্টাল ব্যালট ব্যবস্থা সময়সাপেক্ষ ও অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। এ পদ্ধতিতে সময়মতো ভোট পৌঁছানো সম্ভব হয় না—তাই দেশের বাইরে থেকে পোস্টাল ভোটের কোনো সফল উদাহরণ নেই।
নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার কমিশন দুটি বিকল্প পদ্ধতি প্রস্তাব করেছে—
১. তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর পোস্টাল ভোটিং ব্যবস্থা
২. অনলাইন ইন্টারনেট ভোটিং ব্যবস্থা
ইসি এই দুটি পদ্ধতির পাশাপাশি প্রক্সি ভোটিং বিষয়টিও আলোচনায় এনেছে।
সম্প্রতি লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশন ও যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে ‘আউট অব কান্ট্রি ভোটিং’ বিষয়ে অনলাইন আলোচনায় অংশ নেন নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ।
তিনি জানান, “এই প্রকল্পে প্রবাসী প্রতি ভোটে সরকারের ব্যয় হবে প্রায় ৭০০ টাকা। পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে নিবন্ধন ও ভোটদানের হার কম হলেও এটি আপাতত সবচেয়ে বাস্তবসম্মত পদ্ধতি। ব্যয়বহুল হলেও এটি যৌক্তিক উদ্যোগ।”
তিনি আরও বলেন, প্রবাসীদের কোনো ফি দিতে হবে না।
বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা তুলে ধরে কমিশনার জানান, “পোস্টাল ভোটে প্রবাসীদের নিবন্ধনের হার মাত্র ২.৭ শতাংশ, আর ভোটদানের হার ৩০ শতাংশের নিচে। ভারতের চার কোটি প্রবাসীর মধ্যে সর্বশেষ নির্বাচনে মাত্র ১ লাখ ১৯ হাজার নিবন্ধন করেছেন, ভোট দিয়েছেন মাত্র ২ হাজার ৯০০ জন।”
সানাউল্লাহ বলেন, “বিশ্বজুড়ে পোস্টাল ব্যালটের গড় নষ্ট বা অপচয়ের হার ২৪ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি চারটি ব্যালটের একটি ঠিকানায় পৌঁছায় না।”
কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, অনেক ভোটার ভুল বা অকার্যকর ঠিকানা দেন, আবার অনেকেই সময়মতো ভোট পাঠান না। ফলে সেই ভোট গণনায় অন্তর্ভুক্ত করা যায় না।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের জন্য দুটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে—ব্যালটের গোপনীয়তা রক্ষা করা এবং সময়মতো ভোট ফেরত নিশ্চিত করা।” এজন্য ভোটারদের কাছ থেকে লিখিত ঘোষণা নেওয়া হবে যে, তারা কাকে ভোট দিয়েছেন তা প্রকাশ করবেন না।
আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো—বিদেশে ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার পর দেশে প্রার্থী তালিকায় পরিবর্তন হলে সেই আসনের বিদেশি ভোট বাতিল হয়ে যাবে। “যদি আদালতের আদেশে প্রার্থী পরিবর্তন হয়, তাহলে বিদেশ থেকে পাঠানো সেই ভোটগুলো গণনায় ধরা হবে না,” বলেন তিনি।
আগামী রোজার আগে, অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে ইসির। ডিসেম্বরেই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে।
নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, এবার প্রবাসীদের ভোট অন্তর্ভুক্তি বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থায় নতুন অধ্যায় খুলবে। তবে এটি সফল করতে প্রযুক্তি, সময় ও নিরাপত্তা—সব দিকেই নির্ভুলতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।