পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় পায়রা নদীর তীরে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রস্তুত আছে বাণিজ্যিক উৎপাদনের (সিওডি) অপেক্ষায়। অবকাঠামোগত সব কাজ শেষ হলেও পর্যাপ্ত কয়লা সরবরাহ ও সঞ্চালন লাইনের জটিলতার কারণে কেন্দ্রটির উৎপাদন শুরু বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে।
এই বিলম্বের কারণে প্রতি মাসে অতিরিক্ত প্রায় ১২ মিলিয়ন ডলার—বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৪৬ কোটি ১৬ লাখ টাকা—ব্যয় হচ্ছে পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ, প্রশাসনিক খাত ও পরামর্শক ফি-তে। দৈনিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৫ কোটি টাকা। এই আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি মূল্যায়ন করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (বিপিডিবি) চিঠি দিয়েছে কেন্দ্রটির পরিচালনা প্রতিষ্ঠান আরপিসিএল-নরিনকো পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি লিমিটেড (আরএনপিএল)।
আরএনপিএল বিপিডিবিকে জানিয়েছে, সিওডি বিলম্বিত হওয়ায় অতিরিক্ত ব্যয় যুক্ত হবে প্রকল্পের মোট নির্মাণ ব্যয়ের সঙ্গে। এতে প্রকল্প ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে, যা সরাসরি বিদ্যুৎ উৎপাদন ট্যারিফে প্রভাব ফেলবে। ফলে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহকৃত বিদ্যুতের গড় মূল্যও বাড়তে পারে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট গত ১ মার্চ পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করেছে এবং এখন সীমিতভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। দ্বিতীয় ইউনিট পুরোপুরি বন্ধ অবস্থায় রয়েছে। বর্তমানে উৎপাদন হচ্ছে কেন্দ্রটির মোট সক্ষমতার মাত্র ২৫ শতাংশ।
বাণিজ্যিক উৎপাদন নিয়ে জানতে চাইলে বিপিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী রেজাউল করিম বণিক বলেন, “একটি ইউনিটের জন্য আমরা পিজিসিবি থেকে ক্লিয়ারেন্স পেয়েছি। বাকি ইউনিট ইভাক্যুয়েশন লাইনের ওপর নির্ভর করছে। পিজিসিবি কবে কাজ শেষ করবে, সে বিষয়ে আমরা কিছু জানি না। তবে একটি ইউনিটের বিদ্যুৎ দ্রুত গ্রহণের পরিকল্পনা রয়েছে।”
কয়লা সরবরাহ নিয়ে প্রশ্নে তিনি বলেন, “এটি আরএনপিএলের বিষয়। তারা কয়লা কিনে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে আমরা তা কিনব। না পারলে কিনব না।”
কলাপাড়ার আরএনপিএল বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ ব্যয় প্রায় ২ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার, যার অর্থায়ন করেছে চীনের এক্সিম ব্যাংক। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ১৪ বছর মেয়াদি ঋণচুক্তি হয়, যাতে ৪ বছর গ্রেস পিরিয়ড ছিল। সেই সময় শেষ হয়েছে চলতি বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর। চুক্তি অনুযায়ী, আগামী মার্চের মধ্যে প্রথম কিস্তি পরিশোধ করতে হবে।
বাণিজ্যিক উৎপাদন না শুরু হওয়ায় চীনা ব্যাংক সম্প্রতি প্রকল্প ঋণের ৫৩ মিলিয়ন ডলার সুদ পরিশোধের নোটিশ দিয়েছে আরএনপিএলকে। তবে এই অর্থ পরিশোধ হয়েছে কিনা, তা নিশ্চিত নয়।
প্রকল্প সূত্র জানায়, বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে বছরে প্রয়োজন কমপক্ষে চার মিলিয়ন টন কয়লা, দৈনিক ১২ হাজার টন। বর্তমানে মজুদ কয়লায় কেন্দ্রটি পূর্ণ সক্ষমতায় চালানো যাবে মাত্র ১৭ দিন।
কেন্দ্রটির প্রধান সমস্যা এখন কয়লার সরবরাহ। আড়াই বছরেও সরকার কোনো নির্ভরযোগ্য সরবরাহকারী চূড়ান্ত করতে পারেনি। সিঙ্গাপুরভিত্তিক ইয়াংথাই এনার্জি পিটিই লিমিটেড চার দফায় কারিগরি ও আর্থিকভাবে যোগ্য বিবেচিত হলেও শেষ পর্যন্ত চুক্তি হয়নি। পঞ্চম দফার দরপত্র প্রক্রিয়া এখন আদালতে বিচারাধীন।
বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, “কয়লার টেন্ডার আহ্বান, কারিগরি ও আর্থিক মূল্যায়নসহ পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে চার-পাঁচ মাস সময় লাগে। এর আগে উৎপাদন শুরু করলে এক মাসও কেন্দ্রটি চালানো সম্ভব নয়।”
প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের হিসাব অনুযায়ী, বাণিজ্যিক উৎপাদন আগামী পাঁচ মাস থেমে থাকলে আরএনপিএলের ক্ষতি হবে প্রায় ৭৫০ কোটি টাকা।
২০২২ সালের নভেম্বরে প্রথমবার কয়লা আমদানির দরপত্র আহ্বান করা হয়। এরপর ২০২৩ সালের জানুয়ারি, নভেম্বরে এবং চলতি বছরের মধ্যে মোট পাঁচ দফায় দরপত্র ডাকা হয়, তবে প্রতিবারই তা বাতিল বা স্থগিত হয়েছে। সরকার পরিবর্তনের পর নতুন করে আহ্বান করা দরপত্রও এখন আদালতের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়।
আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তিতে নির্মিত কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত হয় ১৯ জানুয়ারি এবং দ্বিতীয় ইউনিট ৯ এপ্রিল। বর্তমানে বিপিডিবি প্রথম ইউনিট থেকে পরীক্ষামূলকভাবে সীমিত পরিসরে বিদ্যুৎ নিচ্ছে।
সম্প্রতি আরএনপিএলের পরিচালক ও আরপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. নাজমুস সায়াদাত বিপিডিবিকে পাঠানো এক চিঠিতে সম্ভাব্য আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি তুলে ধরেছেন। এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।