বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে থাকে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, দেশে খেলাপি ঋণের সমস্যা ক্রমশই ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, কর্পোরেট গোষ্ঠী ও রাজনৈতিকভাবে সংযুক্ত ব্যক্তিরা বিপুল পরিমাণ ঋণ খেলাপি হয়েও প্রায়শই দায়মুক্ত থাকছেন। অথচ এই অনিয়মের বোঝা গিয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষের কাঁধে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, স্বনির্ভর ব্যবসায়ী এবং সাধারণ আমানতকারীরা আজ নানা বাঁধা, হয়রানি ও আর্থিক সংকটে পড়ছেন। এতে ব্যাংকের শৃঙ্খলা নষ্ট হচ্ছে, আর ঋণ ও আর্থিক সহায়তার সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ছে ঠিক তখনই, যখন বড় খেলাপিরা আইনের ফাঁক গলে অবাধে চলাফেরা করছেন।
এই প্রেক্ষাপটে দেশের ব্যাংক খাতে এক অদ্ভুত বৈপরীত্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বড় ঋণখেলাপিরা শত কোটি থেকে হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ফেরত না দিলেও তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয় না; অনেক ক্ষেত্রে বরং সুবিধা ও সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয়। বিপরীতে ছোট ঋণগ্রহীতা যেমন: গরিব কৃষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কিংবা সাধারণ চাকরিজীবী, অল্প কিছু টাকা বাকি রাখলেই কঠোর হয়রানির শিকার হন। কোথাও জামানত বাজেয়াপ্ত করা হয়, কোথাও আদালতের নোটিশ, এমনকি কারও কারও হাতকড়া পরিয়ে কারাগারে পাঠানোর ঘটনাও ঘটে।
এই বৈপরীত্য শুধু আর্থিক নয়, এটি নৈতিক ও সামাজিক অসাম্যের প্রতীকও বটে। যেখানে প্রভাবশালীরা ঋণ না দিয়েও নিরাপদে থাকে, সেখানে সাধারণ মানুষ সামান্য ঘাটতির জন্য অপমান, মানসিক চাপ ও আইনি ঝুঁকি বহন করে। ব্যাংক খাতের এই অসাম্যই আজ অর্থনীতির ন্যায্যতা, স্বচ্ছতা ও আস্থার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বর্তমান পরিসংখ্যান ও বাস্তব চিত্র: বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত আজ এক গভীর সংকটে পড়েছে। প্রভাবশালীরা ঋণ খেলাপি হয়েও পার পেয়ে যাচ্ছেন, অথচ সাধারণ মানুষ সামান্য কারণে কঠোর হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এই বৈষম্যমূলক চিত্র বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার দীর্ঘদিনের দুর্বলতা, অনিয়ম ও জবাবদিহিতার অভাবের স্পষ্ট প্রতিফলন। খেলাপি ঋণের লাগামহীন বৃদ্ধি, রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্নীতি এবং দুর্বল তদারকি সব মিলিয়ে ব্যাংক খাতের প্রতি জনগণের আস্থা এখন মারাত্মকভাবে নড়বড়ে হয়ে গেছে।
পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, আমানতকারীরা ব্যাংকে টাকা রাখতে ভয় পাচ্ছেন, বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে পারছেন না, এমনকি বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে অনির্ভরযোগ্য মনে করছেন। প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতারা প্রায়ই তাদের খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল বা মওকুফ করার সুযোগ পাচ্ছেন। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ প্রায় অনুপস্থিত। বিপরীতে সাধারণ মানুষ ব্যাংকে নিজের টাকাই তুলতে গেলে নানা হয়রানির মুখে পড়ছেন। ঋণ পরিশোধে সামান্য বিলম্ব বা কাগজপত্রের ঘাটতির মতো তুচ্ছ কারণেও তাদের সঙ্গে কঠোর আচরণ করা হচ্ছে।
এই বৈষম্য ব্যাংক খাতের প্রতি জনগণের আস্থা আরও কমিয়ে দিচ্ছে। অনেকেই এখন মনে করেন, ব্যাংক আর তাদের অর্থের নিরাপদ আশ্রয় নয়। নাগরিক সংগঠন সিটিজেন ভয়েস এর মতে, এই আস্থাহীনতা যদি আরও গভীর হয়, তবে তা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনতে পারে। খেলাপিদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ার ফলে সমাজে একটি বিপজ্জনক ধারণা তৈরি হয়েছে, যে ব্যাংক থেকে ঋণ নিলেও তা ফেরত দিতে হয় না। এই মানসিকতা ইচ্ছাকৃত খেলাপির সংখ্যা বাড়িয়ে তুলছে, যা দেশের আর্থিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতার জন্য এক বড় হুমকি। খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট বাড়ছে, ব্যবসায়িক পরিবেশ সংকুচিত হচ্ছে এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নতুন উদ্যোক্তারা প্রয়োজনীয় ঋণ পাচ্ছেন না, ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টির গতি মন্থর হয়ে পড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আর্থিক খাতে আমূল সংস্কার ছাড়া টেকসই শিল্পায়ন ও দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধি সম্ভব নয়।
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণের হার সর্বাধিক বাংলাদেশে। ২০২৩ সালের শেষে এই হার দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৬ শতাংশ, যা ২০২১ সালে ছিল ৮ শতাংশ এবং ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৭ শতাংশে। অর্থাৎ প্রতিবছরই ঋণ খেলাপির হার বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ (২০২৫) প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের জুনে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ২০২৫ সালের জুন শেষে এই পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকায়, অর্থাৎ এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৩ লাখ ১৯ হাজার ৩৭ কোটি টাকা। বর্তমানে এটি বিতরণ করা মোট ঋণের ২৭ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ, অর্থাৎ ব্যাংক খাতের মোট ঋণের প্রায় চার ভাগের এক ভাগেরও বেশি ইতিমধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে।
২০২৫ সালের মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা, যা ছিল বিতরণ করা ঋণের ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। কিন্তু জুন ২০২৫ শেষে (সেপ্টেম্বর শেষে প্রকাশিত) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৬৭ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের প্রায় ৩৩ শতাংশ। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথমবারের মতো জানিয়েছে যে, দেশে বর্তমানে ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপির সংখ্যা ৩ হাজার ৪৮৩ জন।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। মাত্র ছয় মাসে এসব ব্যাংকের শ্রেণীকৃত ঋণ ১০ শতাংশ বেড়েছে। ২০২৫ সালের জুনে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ছয় ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৯ হাজার ১৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে মাত্র ১২০ জন শীর্ষ খেলাপি গ্রাহকের কাছেই আটকে আছে ৮৫ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট ছয়টি ব্যাংক হলো সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, বেসিক ও বিডিবিএল। তারা নিজেদের প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে যে রাজনৈতিক প্রভাব, অনিয়মিত ঋণ বিতরণ এবং দুর্বল তদারকি এই বিপর্যয়ের মূল কারণ।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের বর্তমান চিত্র উদ্বেগজনক। যেখানে প্রভাবশালীরা ঋণ খেলাপি হয়েও দায়মুক্ত থাকেন, সেখানে সাধারণ মানুষ সামান্য আর্থিক সমস্যায় পড়লেই হয়রানি, মানসিক চাপ ও আইনি জটিলতার শিকার হন। এই বৈষম্য শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি সামাজিক ন্যায়বিচার, আস্থা ও স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রেও এক গুরুতর হুমকি হয়ে উঠেছে। কারণ বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে ঋণ খেলাপির প্রবণতা ও সাধারণ মানুষের উপর এর নেতিবাচক প্রভাবের পেছনে কয়েকটি মূল কারণ রয়েছে। এই সমস্যাগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্বল আইন প্রয়োগ, ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা এবং দুর্নীতির সংস্কৃতি অন্যতম। প্রভাবশালী ব্যক্তিরা রাজনৈতিক সংযোগের মাধ্যমে সহজেই ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের ঋণ গ্রহণ করে, যা পরবর্তীতে খেলাপি হয়ে যায়। এই ঋণ গ্রহীতাদের বিরুদ্ধে কার্যকর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে রাজনৈতিক বাঁধা সৃষ্টি হয়, ফলে তারা দায়মুক্তি পেয়ে যায়।
ব্যাংকগুলোর মধ্যে অনিয়মিত ঋণ বিতরণ ও দুর্নীতি প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতাদের ঋণ পরিশোধে গড়িমসি করতে উৎসাহিত করে। অথচ সাধারণ ঋণগ্রহীতাদের ঋণ পরিশোধে সামান্য বিলম্ব বা কাগজপত্রের ঘাটতির মতো তুচ্ছ কারণে কঠোর হয়রানির শিকার হতে হয়। এডিবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণের হার সর্বাধিক বাংলাদেশে। খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের বিরুদ্ধে আইনের প্রয়োগের অভাব ও ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগের কারণে তারা ঋণ পরিশোধে গড়িমসি করে। এতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে এবং সাধারণ মানুষকে ঋণ পরিশোধে কঠোর হতে হচ্ছে। এই কারণগুলো বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের বর্তমান সংকটের মূল উৎস এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি স্বরূপ।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে প্রভাবশালীদের ঋণ খেলাপি হওয়া সত্ত্বেও দায়মুক্তি এবং সাধারণ মানুষের হয়রানির প্রধান প্রভাবগুলো হলো ব্যাংকিং খাতের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কমে যাওয়া, অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধি এবং খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকের মূলধন ও তারল্যের সংকট সৃষ্টি হওয়া। এই প্রবণতার কারণে ব্যাংকগুলো সাধারণ গ্রাহকদের টাকা তুলতে এবং ঋণ দিতে হিমশিম খায়, যার ফলে অর্থনৈতিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। ব্যাংকিং খাতের প্রতি আস্থার সংকট দিন দিন বাড়ছে। জনগণের আস্থার অভাব প্রকট হচ্ছে। যখন প্রভাবশালীরা ঋণখেলাপি হওয়া সত্ত্বেও দায়মুক্তি পায় এবং সাধারণ গ্রাহকদের হয়রানির শিকার হতে হয়, তখন তারা মনে করে ব্যাংক তাদের অর্থের নিরাপদ আশ্রয় নয়। এর ফলে আমানত কমে যাচ্ছে। আস্থার এই অভাব আমানতকারীদের ব্যাংকিং খাতে টাকা রাখতে নিরুৎসাহিত করে, যা ব্যাংকের তারল্য সংকটকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
অর্থনৈতিক খাতে এর প্রভাব আরো বেশি প্রতিফলিত হয়। এতে অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়। খেলাপি ঋণের উচ্চ হার অর্থনীতির জন্য একটি বড় ঝুঁকি, যা সামগ্রিক আর্থিক কাঠামোকে নাজুক করে তোলে এবং দেশের অর্থনৈতিক অর্জনকে ঝুঁকির মুখে ফেলে। তাছাড়া ঋণ প্রবাহে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। ব্যাংকগুলো ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হয়ে যায়, যার ফলে সাধারণ মানুষ ও ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্রয়োজনীয় ঋণ পায় না, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে।
এতে ব্যাংকের উপর চাপ সৃষ্টি করে, ফলে মূলধন ও তারল্যের ঘাটতি দেখা দেয়। খেলাপি ঋণের বোঝা ব্যাংকগুলোর মূলধন ও তারল্যকে মারাত্মকভাবে কমিয়ে দেয়, যা ব্যাংকগুলোকে পরিচালনা ও আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে অক্ষম করে তোলে। অদক্ষ প্রশাসনের ব্যর্থতার জন্য খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পায়। রাজনৈতিক প্রভাব এবং দুর্বল প্রশাসন খেলাপি ঋণ বাড়াতে সাহায্য করে, যা ব্যাংকগুলোর অদক্ষতা এবং দুর্বল শাসনের প্রমাণ দেয়।
আমানতকারীদের হয়রানির ফলে ব্যাংকের প্রতি আস্থা কমে যায়। আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থতা বা হয়রানির শিকার হওয়া, ব্যাংকগুলোর এই সংকটের একটি প্রত্যক্ষ প্রভাব।
এই পরিস্থিতি দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও ব্যাংকিং খাতের সুস্বাস্থ্য রক্ষায় একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতাদের দৃষ্টান্ত: বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত বর্তমানে এক গভীর সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্বল আইনি প্রয়োগ, প্রশাসনিক অদক্ষতা ও দুর্নীতির সংস্কৃতি মিলে প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতারা ঋণ পরিশোধ না করেও দায়মুক্ত থেকে যাচ্ছেন, অথচ সাধারণ মানুষ ব্যাংকিং ব্যবস্থায় হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এই বৈষম্য এখন দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতার অন্যতম বড় হুমকি হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
রাজনৈতিকভাবে সংযুক্ত ও অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তি এবং কর্পোরেট গোষ্ঠী বছরের পর বছর ব্যাংক থেকে বিপুল অঙ্কের ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করেই পার পাচ্ছেন। তারা রাজনৈতিক প্রভাব বা প্রশাসনিক যোগসাজশের মাধ্যমে ঋণ পুনঃতফসিল, সুদ মওকুফ কিংবা মামলার স্থগিতাদেশ আদায় করে নিচ্ছেন। অন্যদিকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বা সাধারণ গ্রাহক সামান্য বিলম্বে ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ফলে ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট বেড়েছে, আর ব্যাংক খাতের প্রতি জনগণের আস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বর্তমানে প্রায় ১৭ হাজার ১৮২ কোটি টাকা, যা ব্যাংকের মোট বিতরণকৃত ঋণের ৩৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ। সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৯ হাজার ৯১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২১ দশমিক ১১ শতাংশ। অগ্রণী, রূপালী, বেসিক এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) মিলিয়ে ছয়টি রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণের মোট পরিমাণ এখন প্রায় ১ লাখ ৪৯ হাজার ১৪০ কোটি টাকা।
খেলাপি ঋণ বলতে বোঝায় সেইসব ঋণ যা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরিশোধ করা হয়নি বা ফেরত আসেনি। এই ঋণ এখন ব্যাংকিং খাতের জন্য এক গভীর উদ্বেগের কারণ। কারণ ব্যাংকগুলো আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে হিমশিম খাচ্ছে, তারল্য সংকট তৈরি হচ্ছে এবং সঞ্চয়কারীদের আস্থা কমে যাচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন, এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা আরও নড়বড়ে হয়ে পড়বে এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হবে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যবসায়িক গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ বিপুল পরিমাণ অর্থ, ঋণ জালিয়াতি ও অর্থ পাচারের অভিযোগে আবারও আলোচনায় এসেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর অঞ্চল–১৫-এর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম, তাঁর পরিবারের সদস্য ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে দেশের ছয়টি ব্যাংকে প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকার নগদ আমানতের সন্ধান মিলেছে।
তদন্তে আরও প্রকাশ পেয়েছে, গত পাঁচ বছরে এস আলম গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ছয়টি ব্যাংকের হিসাবে প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে, যার বেশিরভাগই ঋণের অর্থ হিসেবে জমা। শুধু এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলস লিমিটেডের একাধিক হিসাবেই প্রায় ৮৩ হাজার ৭০৬ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। এসব অর্থের উৎস ও ব্যবহারের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এনবিআরের তদন্ত দল। তাদের ধারণা, নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে দেশে-বিদেশে অর্থ পাচার করা হয়েছে।
এস আলম গ্রুপের বিপুল অঙ্কের অর্থ লেনদেন পাওয়া গেছে যে ছয়টি ব্যাংকে, সেগুলো হলো ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, এক্সিম ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, আল–আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক এবং ন্যাশনাল ব্যাংক। এর মধ্যে এক্সিম ও আল–আরাফাহ্ ছাড়া বাকি চারটি ব্যাংক সরাসরি এস আলম গ্রুপের মালিকানায় ছিল। এমনকি আল–আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকও কার্যত তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল বলে তদন্তে উঠে এসেছে। এই অনিয়ম ও স্বার্থের দ্বন্দ্বের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি এসব ব্যাংকের পুরোনো পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করে নতুন পর্ষদ নিয়োগ দিয়েছে ব্যাংকগুলোর শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে।
অন্যদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেড (বর্তমানে আভিভা ফাইন্যান্স) থেকে তিন দফায় মোট ১০০ কোটি টাকা ঋণ আত্মসাতের অভিযোগে তিনটি মামলায় অভিযোগপত্র দাখিলের অনুমোদন দিয়েছে। প্রথম ধাপে ৩২ কোটি ৫০ লাখ টাকা ঋণ তুলে তা সরাসরি এস আলম এডিবল অয়েল লিমিটেডে স্থানান্তর করা হয়। পরবর্তীতে আরও দু’টি মামলায় ২৪ কোটি ও ৩৪ কোটি টাকার জালিয়াতির অভিযোগ আনা হয়েছে একই আসামিদের বিরুদ্ধে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এস আলম গ্রুপের ঘটনা কেবল একটি ব্যবসায়িক অনিয়ম নয়, এটি বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্নীতি ও সুশাসনের অভাবের প্রকৃষ্ট প্রতিফলন। প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতাদের এই দায়মুক্তি কেবল ব্যাংক খাত নয়, গোটা অর্থনীতিকেই গভীর ঝুঁকির মুখে ফেলছে। যদি দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে ব্যাংকিং খাতের প্রতি জনগণের আস্থা সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য এক ভয়াবহ সংকেত।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের বর্তমান সংকট নিরসনে প্রয়োজন বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ ও দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা। খেলাপি ঋণ ও প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতাদের দায়মুক্তির সংস্কৃতি বন্ধ করতে হলে প্রথমেই ঋণ ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি বড় ঋণ অনুমোদনের আগে ঋণগ্রহীতার প্রকৃত মালিকানা ও আর্থিক সক্ষমতা যাচাই বাধ্যতামূলক করা জরুরি, যাতে নামে-বেনামে ঋণ গ্রহণ ও অর্থ পাচারের সুযোগ না থাকে।
ব্যাংক খাতে অনিয়ম ও জালিয়াতি রোধে একটি স্বাধীন আর্থিক অপরাধ তদন্ত সংস্থা গঠন করা প্রয়োজন, যা ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতি, ঋণ জাল ও অর্থ পাচার সংক্রান্ত অপরাধ তদন্ত করবে। পাশাপাশি পুনঃতফসিল ও পুনঃঅর্থায়নের নীতিতে কঠোরতা আনা দরকার, যাতে একই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বারবার ঋণখেলাপি হয়েও দায়মুক্ত না পায়। এই ক্ষেত্রে একটি কেন্দ্রীয় “ক্রেডিট ব্ল্যাকলিস্ট” চালু করা যেতে পারে, যেখানে অনিয়মকারী ঋণগ্রহীতাদের নাম অন্তর্ভুক্ত থাকবে এবং তারা ভবিষ্যতে কোনো ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারবে না।
রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ব্যাংক পরিচালনা নিশ্চিত করা এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে রাজনৈতিক নিয়োগ বন্ধ করে পেশাদার ও অভিজ্ঞ ব্যাংকারদের নিয়োগ দিতে হবে। ব্যাংক পরিচালনা ও তদারকির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও স্বাধীন ও শক্তিশালী করতে হবে, যাতে তারা বড় ঋণ অনুমোদন, পুনঃতফসিল বা ঋণ মওকুফের আগে কার্যকরভাবে নজরদারি করতে পারে। দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যক্রমে গতি আনতে হবে এবং বড় ঋণ জালিয়াতির মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য একটি বিশেষ আর্থিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করা প্রয়োজন। এতে বিচারপ্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে এবং অনিয়মকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। একই সঙ্গে ব্যাংক খাতে তথ্যপ্রকাশের বাধ্যবাধকতা জোরদার করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে নিয়মিতভাবে বড় খেলাপিদের নাম, ঋণের পরিমাণ ও মামলার অগ্রগতি প্রকাশ করা হলে জনগণের আস্থা বাড়বে এবং অনিয়ম কমবে।
অন্যদিকে সাধারণ আমানতকারীর অর্থ সুরক্ষায় একটি বিশেষ আইন প্রণয়ন জরুরি, যাতে কোনো ব্যাংক ধস নামলেও ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীরা ক্ষতিগ্রস্ত না হন। ব্যাংকের পরিচালক ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দায়বদ্ধতাও বাড়াতে হবে। যদি প্রমাণিত হয় যে তাদের সিদ্ধান্তে অনিয়ম বা দুর্নীতি হয়েছে, তবে তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার ব্যবস্থা করা উচিত। এছাড়া ঋণ ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ও তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে ঋণ অনুমোদন প্রক্রিয়ায় মানবিক প্রভাব বা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কমে আসে। পরিশেষে ব্যাংকগুলোকে প্রভাবশালী গোষ্ঠীর পরিবর্তে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও উৎপাদনমুখী খাতে ঋণ প্রবাহ বাড়াতে হবে, যাতে প্রকৃত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয় এবং ব্যাংক খাতের প্রতি জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করা যায়।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতাদের দায়মুক্তি এবং সাধারণ মানুষকে হয়রানির শিকার হওয়া শুধু আর্থিক অনিয়মের বিষয় নয়; এটি দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সামাজিক ন্যায়ের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। যখন বড় ঋণগ্রহীতা বছরের পর বছর ঋণ পরিশোধ না করেও পার পেয়ে যায় এবং সাধারণ মানুষ সামান্য দেরিতে বা কাগজপত্রের ঘাটতির কারণে হয়রানির শিকার হয়, তখন জনগণের ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি আস্থা ক্ষুণ্ণ হয়। এর ফলে আমানতকারীরা টাকা রাখতেও সংকোচ করে, ব্যাংকের ঋণ প্রদানে স্থবিরতা দেখা দেয় এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হয়। অথচ সাধারণ ঋণগ্রহীতাদের ঋণ পরিশোধে সামান্য বিলম্ব বা কাগজপত্রের ঘাটতির মতো তুচ্ছ কারণে কঠোর হয়রানির শিকার হতে হয়।
ব্যাংকিং খাতের বর্তমান পরিস্থিতিতে যে প্রতিফলন ঘটেছে তাতে দেখা যাচ্ছে যে, দায়বদ্ধতা ও স্বচ্ছতার অভাব বাংলাদেশের আর্থিক ব্যবস্থাকে গভীর ঝুঁকিতে ফেলেছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রয়োজন কঠোর নিয়ন্ত্রণ, স্বচ্ছ নীতিমালা, দায়বদ্ধ প্রশাসন এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ব্যাংকিং পরিবেশ। শুধুমাত্র এই পরিবর্তনের মাধ্যমে ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব এবং সাধারণ মানুষের আস্থা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। ন্যায়, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মাধ্যমেই আমরা নিশ্চিত করতে পারি, যে ব্যাংকিং খাত সকলের জন্য নিরাপদ এবং সুশৃঙ্খলভাবে কাজ করবে।