দেশের বৃহত্তম রপ্তানি বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) স্বাক্ষরের প্রস্তুতি শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের পর ইউরোপীয় বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার বজায় রাখাই এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে একটি সম্ভাব্যতা যাচাই সম্পন্ন করেছে। এতে দেখা গেছে, ইইউ-এর সঙ্গে এফটিএ স্বাক্ষর হলে বাংলাদেশ লাভবান হবে। আগামী নভেম্বরে ইইউ প্রতিনিধিদলের ঢাকা সফরের সময় আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হবে। বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, “আমরা সম্ভাব্যতা যাচাই করেছি। এটি দেখিয়েছে, বাংলাদেশ এফটিএ থেকে লাভবান হবে। ইইউ-এর সঙ্গে আমাদের প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। তারা এফটিএ করার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এখন আমরা ইইউকে চিঠি দেব, তারা চুক্তির খসড়া পাঠাবে নাকি আমরা পাঠাব। ইইউ ইতোমধ্যেই অনেক দেশের সঙ্গে এফটিএ করেছে, আর আমরা কিছু দেশের সঙ্গে নেগোশিয়েশন করছি।”
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৪৪ শতাংশ হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নে, যা প্রায় ২১.৩৮ বিলিয়ন ডলার। ইইউ’র তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ৯৪ শতাংশ টেক্সটাইল। অন্যদিকে, বাংলাদেশে ইইউ থেকে আমদানি করা পণ্যের মধ্যে মেশিনারিজ ও কেমিক্যাল ছিল যথাক্রমে ৩৫ ও ২১ শতাংশ।
বর্তমানে বাংলাদেশ ইইউ-এর ‘এভরিথিং বাট আর্মস’ (ইবিএ) স্কিমের আওতায় সব পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাচ্ছে। এলডিসি উত্তরণের তিন বছর পর অর্থাৎ ২০২৯ সাল পর্যন্ত এই সুবিধা বহাল থাকবে। এরপর বাংলাদেশ ‘জেনারালাইজড স্কিম অব প্রেফারেন্সেস প্লাস’ (জিএসপি প্লাস) যোগ্য হবে। তবে এই কাঠামোতে তৈরি পোশাকের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধা নেই। ফলে গড়ে ১২ শতাংশ শুল্ক আরোপের আশঙ্কা রয়েছে, যা দেশের প্রধান রপ্তানিখাতের প্রতিযোগিতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের জিএসপি প্লাস শর্ত অনুযায়ী কোনো দেশের একটি পণ্যের আমদানি যদি ইইউর মোট আমদানির ৯ শতাংশ হয়, তবে সেই পণ্যের জন্য জিএসপি প্লাস সুবিধা পাওয়া যাবে না। বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের তৈরি পোশাক আমদানি মধ্যে বাংলাদেশই দখল করছে প্রায় ১৬.৫০ শতাংশ। তাই এলডিসি গ্রাজুয়েশনের তিন বছর পর থেকে তৈরি পোশাকের শুল্কমুক্ত সুবিধা বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এলডিসি হিসেবে বর্তমানে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ‘সিঙ্গেল স্টেজ’ রুলস অব অরিজিন মানতে হয়। অর্থাৎ ফেব্রিক আমদানি করে শুধু সেলাই করেও শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া যায়। তবে জিএসপি প্লাসের আওতায় আরও কঠোর ‘ডাবল স্টেজ’ শর্ত পূরণ করতে হবে। এতে তুলা থেকে সুতা, সুতা থেকে ফেব্রিক, ফেব্রিক থেকে তৈরি পোশাক—এই তিন ধাপের যেকোন দুইটি ধাপ বাংলাদেশে করতে হবে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ইইউকে এসব শর্ত পরিবর্তনের অনুরোধ জানিয়েছে। ইইউ কর্মকর্তারা মৌখিকভাবে আশ্বাস দিয়েছেন, তবে আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ এখনো নেওয়া হয়নি।
বাংলাদেশ ইবিএ স্কিমের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী। ২০২৩ সালে ১৯.৯৪ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি এই সুবিধার আওতায় গেছে। ইউটিলাইজেশন রেট ছিল ৯১ শতাংশ। একই বছরে ইইউ থেকে বাংলাদেশে বিনিয়োগ ছিল ২.৪৫ বিলিয়ন ডলার, আর বাংলাদেশি বিনিয়োগ ইইউতে ১১০.৮৮ মিলিয়ন ডলার। বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এফটিএ স্বাক্ষর শুল্কমুক্ত সুবিধা দীর্ঘমেয়াদে নিশ্চিত করতে পারে। তবে আপাতত জিএসপি প্লাস পথটি বাস্তবসম্মত।
গবেষণা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড) চেয়ারম্যান ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, “এফটিএ না করেও যদি জিএসপি প্লাসে তৈরি পোশাকের শুল্কমুক্ত সুবিধা নিশ্চিত করা যায়, তবে সেটি বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে লাভজনক হবে। তা না হলে এফটিএর মাধ্যমে ইইউ বাজারে সুবিধা নিতে হবে। তবে বাংলাদেশকেও পাল্টা সুবিধা দিতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “ইউরোপের সঙ্গে এফটিএ আলোচনা দীর্ঘ সময় নিতে পারে। ২০২৯ সালের পর যদি জিএসপি প্লাসে শুল্কমুক্ত সুবিধা না থাকে, তবে আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশকে বর্তমান সুবিধা অব্যাহত রাখার সুযোগ মিলবে।” তিনি উদাহরণ দিয়েছেন, ভারতের সঙ্গে ইইউর এফটিএ আলোচনা ২০০৭ সালে শুরু হয়, ২০১৩ সালে স্থগিত হয় এবং ২০২২ সালে পুনরায় শুরু হয়।
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) প্রশাসক ও সাবেক বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেল মহাপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান বলেন, “এলডিসি উত্তরণের পর শুল্কমুক্ত সুবিধা বজায় রাখতে এফটিএ স্বাক্ষরের উদ্যোগ যৌক্তিক। ভারত ইইউর সঙ্গে আলোচনা করছে, ভিয়েতনাম ইতোমধ্যেই করেছে। বাংলাদেশ আগেভাগে আলোচনা শুরু করলে বর্তমান সিঙ্গেল-স্টেজ সুবিধা ধরে রাখতে পারবে।”
সাবেক বাণিজ্য কমিশনার মোস্তাফিজুর রহমান জানান, ইইউ মৌখিকভাবে আশ্বাস দিয়েছে যে ২০২৯ সালের পরও বাংলাদেশ জিএসপি প্লাস সুবিধা এবং তৈরি পোশাকের শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। “এফটিএ আলোচনা শুরুর আগে এটি নিশ্চিত করা বুদ্ধিমানের কাজ হতো,” তিনি বলেন। বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, “ইইউর সঙ্গে এফটিএ স্বাক্ষর জরুরি, তবে অগ্রাধিকার হওয়া উচিত পোশাক খাতের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার বজায় রাখা।”
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আগামী মাসে ইইউর সঙ্গে ‘ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট অন কমপ্রিহেনসিভ পার্টনারশিপ অ্যান্ড কো-অপারেশন (পিসিএ)’ স্বাক্ষরের প্রস্তুতি নিচ্ছে। চুক্তির লক্ষ্য মানবাধিকার, সুশাসন, গণতন্ত্র, শ্রমমান, অভিবাসী সুরক্ষা ও লিঙ্গ সমতার মতো ক্ষেত্রে সহযোগিতা জোরদার করা।
উভয় পক্ষের কর্মকর্তারা ৯–১০ অক্টোবর ভার্চুয়াল বৈঠকে খসড়া চূড়ান্ত করার জন্য আলোচনা করেছেন। ইইউ চেয়েছে বাংলাদেশ জাতিসংঘের মানবাধিকার কনভেনশন বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হোক। বাংলাদেশ জানিয়েছে, এখন রাজনৈতিক পরিবর্তনের সময় চলছে, নতুন নির্বাচিত সরকার আগামী বছরের শুরুতে দায়িত্ব নেবে। বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান স্পষ্ট করেছেন, পিসিএ এবং এফটিএ দুটি পৃথক প্রক্রিয়া। তবে নভেম্বরে ইইউ প্রতিনিধিদলের সফরের সময় দুটি বিষয়ে একযোগে এগোনো যেতে পারে।