সাধারণত ‘ফ্রি ভিসা’ বাণিজ্যের মাধ্যমে বিদেশে অভিবাসনের নামে বাংলাদেশ থেকে বছরে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। রেমিট্যান্স আয় হ্রাসের পাশাপাশি পরিবারগুলোর ঋণের বোঝা বাড়াচ্ছে এই পথ। তথ্যটি উঠে এসেছে ‘রেমিট্যান্স আয় পড়ে যাওয়ার একটি সমালোচনামূলক মূল্যায়ন বাংলাদেশের ‘ফ্রি ভিসা’ অভিবাসনের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিণতি উন্মোচন’ শীর্ষক গবেষণায়।
আজ (রবিবার) রাজধানীর একটি হোটেলে গবেষণার তথ্য তুলে ধরেন অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম (ওকাপ)-এর চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম। গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে বাংলাদেশে সুইজারল্যান্ড দূতাবাসের অর্থায়নে এবং হেলভেটাস সুইস ইন্টারকো-অপারেশনের সমর্থনে, স্ট্রেন্থড অ্যান্ড ইনফরমেটিভ মাইগ্রেশন সিস্টেমস (এসআইএমএস) প্রকল্পের আওতায়।
ওকাপের চেয়ারম্যান বলেন, বিদেশে যাওয়া বাংলাদেশের কর্মীদের সবচেয়ে বেশি অর্থ ‘ফ্রি ভিসা’ বা অনলাইন ভিসা বাণিজ্যে খরচ হচ্ছে। গবেষণায় ১ হাজার ৮৪ জন অভিবাসীর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৫১ শতাংশ কর্মী ‘ফ্রি ভিসা’ এবং ৪৯ শতাংশ কর্মী নিয়মিত কাজের ভিসা নিয়ে বিদেশ গেছেন। তিনি আরও বলেন, “‘ফ্রি ভিসা’ শব্দটি বিভ্রান্তিকর। এটি বিনামূল্যে নয় এবং আইনগতভাবে স্বীকৃতও নয়। এটি মূলত শোষণমূলক নেটওয়ার্কের হাতিয়ার, যা অভিবাসন ব্যয় বাড়াচ্ছে, পরিবারগুলোকে ঋণের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে এবং জাতীয় রেমিট্যান্স প্রবাহ কমিয়ে দিচ্ছে।”
ওকাপের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে উপসাগরীয় দেশগুলোতে অভিবাসিত প্রায় অর্ধেক কর্মী ‘ফ্রি ভিসা’ ব্যবহার করেছেন। তারা সরকার অনুমোদিত ফি থেকে তিন থেকে ছয় গুণ বেশি অর্থ প্রদান করেছেন। এর ফলে পারিবারিক অর্থনৈতিক ক্ষতি, ঋণের চক্র এবং সামষ্টিক রেমিট্যান্স হ্রাস পেয়েছে, যা দেশের জিডিপির ০.৫৪ শতাংশ পর্যন্ত প্রভাব ফেলেছে।
নিয়মিত ভিসার তুলনায় ‘ফ্রি ভিসা’তে অভিবাসন ব্যয় অনেক বেশি। উদাহরণস্বরূপ, কুয়েতে সরকার নির্ধারিত খরচ ১ লাখ ৬ হাজার ৭৮০ টাকা। ‘ফ্রি ভিসা’তে খরচ দাঁড়ায় ৭ লাখ ৩৩ হাজার ৩০৩ টাকা, এবং নিয়মিত কাজের ভিসায় ৬ লাখ ১৯ হাজার ১৬৭ টাকা। একইভাবে সৌদি আরব, ওমান, কাতার ও দুবাইতে খরচ ৩-৪ গুণ বেশি।
তথ্য অনুযায়ী, গন্তব্য দেশে পৌঁছার পরও অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হয় কর্মীদের। এর মধ্যে রয়েছে ওয়ার্ক পারমিট, নতুন চাকরি পাওয়া ও খাবারের খরচ। সব মিলিয়ে একজন কর্মীর মোট ব্যয় হয় ৭ লাখ ২২ হাজার ৭০০ টাকা। ফলে গড়ে প্রতিটি কর্মীর অভিবাসন ব্যয় দাঁড়ায় সাড়ে ৬ লাখ টাকা।
গবেষণায় দেখা গেছে, ৫৭ শতাংশ কর্মী ওয়ার্ক পারমিট ছাড়াই কাজ শুরু করেছেন। ২১ শতাংশকে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করতে হয়েছে, যার গড় খরচ ১ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। ৪ শতাংশ কর্মী অতিরিক্ত ৪৪ হাজার টাকা খরচ করেছেন চাকরি পাওয়ার জন্য। এইভাবে ‘ফ্রি ভিসা’ বাণিজ্যের কারণে দেশে প্রায় ১৮ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়া। তিনি গবেষণার তথ্য তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ জানান। প্যানেল আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)-এর প্রকল্প ব্যবস্থাপক রাহনুমা সালাম খান, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)-এর মাইগ্রেশন পলিসি ও সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট ইউনিটের হেড শ্রুতি ইশিতা, এবং ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের অধ্যাপক ড. কাজী মাহমুদুর রহমান।
এছাড়া জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন (বায়রা)-এর প্রশাসক মো. আশরাফ হোসেন, সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান, সাবেক সহ-সভাপতি নোমান চৌধুরী, ঢাকার সুইজারল্যান্ড দূতাবাসের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার নাজিয়া হায়দার, ওকাপের নির্বাহী পরিচালক ওমর ফারুক এবং অনুষ্ঠান সঞ্চালক ওকাপের প্রোগ্রাম সমন্বয়ক এ এ মামুন নাসিম উপস্থিত ছিলেন।