গত কয়েক দিন ধরে একের পর এক ধাক্কায় দিশেহারা দেশের ব্যবসায়ীরা। বড় ধরনের চাপের মুখে পড়েছে রপ্তানি ও আমদানির শৃঙ্খল। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে শুরু হওয়া এই বিপর্যয় এখন পুরো বাণিজ্য খাতকে নাজুক অবস্থায় ফেলেছে।
প্রথম আঘাতটি আসে ১৫ অক্টোবর। সেদিন কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই ধর্মঘট ডাকে প্রাইম মুভার মালিক সমিতি। কারণ, বন্দর এলাকায় ভারী যানবাহনের গেট পাস ফি ৫৭ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৩০ টাকা করা হয়—অর্থাৎ প্রায় ৩০০ শতাংশ বৃদ্ধি। এই অতিরিক্ত ফি-র প্রতিবাদে তারা বন্দর থেকে কনটেইনার পরিবহন বন্ধ রাখে।
ফলে চার দিন ধরে কার্যত স্থবির হয়ে পড়ে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর। কনটেইনার ওঠানামা কমে যায় প্রায় ৪৫ শতাংশ। বন্দরের ইয়ার্ডগুলোতে পণ্যবোঝাই কনটেইনার জমে যায়, ব্যাহত হয় আমদানি ও রপ্তানি কার্যক্রম। ফলে আমদানি-রপ্তানিকারকদের মধ্যে দেখা দেয় চরম ক্ষোভ ও হতাশা। অবশেষে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ) অতিরিক্ত ফি প্রত্যাহার করলে ধর্মঘট তুলে নেয় মালিক সমিতি। গতকাল রোববার থেকে বন্দর কার্যক্রম স্বাভাবিক হলেও ইতোমধ্যেই ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। চট্টগ্রাম বন্দরের ধর্মঘটের রেশ কাটতে না কাটতেই এবার আন্দোলনে নেমেছে কাস্টমস এজেন্টরাও। বাংলাদেশ কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সাইফুল আলম জানিয়েছেন, তাদের আংশিক কর্মবিরতি চলবে পুরো সপ্তাহজুড়ে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন এক হুঁশিয়ারি। ব্যবসায়ী নেতারা সতর্ক করে বলেছেন, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ) যদি ১৫ অক্টোবর থেকে কার্যকর গড়ে ৪১ শতাংশ বাড়ানো মাশুল প্রত্যাহার না করে, তবে তারা বন্দর কার্যক্রম বন্ধ করে দেবেন। আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছে এক সপ্তাহের জন্য। উদ্বেগের কারণও যথেষ্ট। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই দেশের মোট আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রায় ৯০ শতাংশ সম্পন্ন হয়। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে সেই বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ১২০ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, এই বন্দর থমকে গেলে পুরো অর্থনীতিই বড় সংকটে পড়বে।
এদিকে, বন্দর সংকটের মধ্যেই দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে অগ্নিকাণ্ডের আতঙ্ক। গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম ইপিজেডের একটি বড় কারখানায় ভয়াবহ আগুন লাগে। এর দুই দিন পর শনিবার ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো ভিলেজে আগুনে পুড়ে যায় গুদামভর্তি পণ্য।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে বলেন, “এই অগ্নিকাণ্ড দেশের ব্যবসায়ীদের হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি করেছে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করবে।” আগুন লাগার পর থেকেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে আমদানিকারক ও ক্লিয়ারিং এজেন্টদের মধ্যে। শনিবারের ছুটির দিনেও অনেকে ফোনে পণ্যের খোঁজ নিচ্ছিলেন।
রুহুল ইন্টারন্যাশনালের সিএন্ডএফ প্রতিনিধি আলাল আহমেদ বলেন, “আমাদের প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৪০ হাজার ডলারের মালামাল ছিল। সব পুড়ে গেছে বলে জানতে পেরেছি। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ক্রমাগত ফোন দিচ্ছে।”
এসআর ইন্টারন্যাশনালের মোশাররফ হোসেন জানান, “আমাদের ভিভো মোবাইলের প্রায় ১০ হাজার কেজি খুচরা যন্ত্রাংশসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মালামাল ছিল। সব পুড়ে গেছে বলে খবর পেয়েছি। এতে প্রায় ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হবে।”
স্যালভেশন লজিস্টিকস লিমিটেডের কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, “শাওমি, ওপ্পো, রিয়েলমি, ওয়ানপ্লাস ও স্যামসাংসহ বেশিরভাগ মোবাইল কোম্পানি আমাদের মাধ্যমে তাদের অ্যাক্সেসরিজ আমদানি করে। সেই কার্গোতেই ছিল পণ্যের বড় অংশ। সব পুড়ে গেছে, ক্ষতি প্রায় ২৫০ কোটি টাকার।”
সিএন্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের নেতা কাজী আজমল হোসেন বলেন, “ক্ষতির মাত্রা অভাবনীয়। প্রতিদিন ঢাকা বিমানবন্দর দিয়ে প্রায় ৪ হাজার বিল অব এন্ট্রি আসে। সমুদ্রপথের বদলে যারা বিমানপথে পণ্য আমদানি করে, সেই ছোট আমদানিকারকরাই আগুনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।”
বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের অবহেলা:
গত শনিবার ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর ২৬ ঘণ্টা লেগেছে আগুন সম্পূর্ণ নেভাতে। গতকাল রোববার বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এ দীর্ঘ সময় ধরে আগুন জ্বলতে থাকায় ব্যবসায়ীরা প্রশ্ন তুলেছেন—আগুন এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল কেন, আর নিয়ন্ত্রণে আনতে এত সময় লাগল কেন?
গতকাল (রোববার) সন্ধ্যায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। সংস্থাটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে কোনো অগ্নি শনাক্তকরণ বা সুরক্ষা ব্যবস্থা ছিল না। বিকেল ৫টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশনস অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, “যদি সেখানে ডিটেকশন ও প্রোটেকশন সিস্টেম থাকত, এত বড় দুর্ঘটনা ঘটত না। আমরা এমন কোনো ব্যবস্থা পাইনি। তাই আগুন কীভাবে ও কখন লেগেছে—তা জানতে তদন্ত প্রয়োজন।”
ব্যবসায়ী নেতারা এ দুর্ঘটনার জন্য সরাসরি দায়ী করেছেন বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের অবহেলাকে। বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “অবশ্যই এখানে অবহেলা রয়েছে। বিমানবন্দরের নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকার কথা। সিভিল এভিয়েশনের কি এই প্রস্তুতি ছিল না? যদি না থাকে, তবে দায়ীদের খুঁজে বের করতে হবে।”
বেসামরিক বিমান চলাচল উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন রোববার সাংবাদিকদের জানান, অগ্নিকাণ্ডের কারণ জানতে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করা হবে। এই দুর্ঘটনা ঘটেছে এমন এক সময়ে, যখন মাত্র ছয় দিন আগেই শাহজালাল বিমানবন্দর শতভাগ কার্গো নিরাপত্তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছিল। অথচ অল্প সময়ের মধ্যেই সেই বিমানবন্দরে এমন অগ্নিকাণ্ড দেশের ভাবমূর্তিকে গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আমদানি–রপ্তানির প্রধান কেন্দ্র কার্গো ভিলেজ পুড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করছেন, বিদেশি ক্রেতারা সময়মতো পণ্য না পেলে ক্ষতির পরিমাণ ১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে। কারণ, অনেক ক্রেতা সময়মতো চালান না পেলে অর্ডার বাতিল করতে পারেন।
চট্টগ্রাম বন্দরের ৪১% বর্ধিত মাশুল প্রত্যাহারে ব্যবসায়ীদের ৭ দিনের আলটিমেটাম:
চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা ১৫ অক্টোবর থেকে কার্যকর গড়ে ৪১ শতাংশ বাড়ানো ট্যারিফ বা মাশুল প্রত্যাহারের দাবিতে সরকারকে সাত দিনের সময় দিয়েছেন। দাবি না মানলে বন্দর কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা। গত শনিবার চট্টগ্রামে পোর্ট ইউজার্স ফোরাম বা বন্দর ব্যবহারকারী ফোরামের আয়োজিত এক প্রতিবাদ সমাবেশে এ ঘোষণা দেওয়া হয়। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (সিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আমীর হুমায়ুন চৌধুরী।
হুমায়ুন জানান, ব্যবসায়ীরা ইতোমধ্যে ১৪ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টার কাছে একটি স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন, যেখানে বর্ধিত মাশুল প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, “এই বাড়তি ট্যারিফ শুধু চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের নয়, দেশের সার্বিক বাণিজ্য ও ভোক্তা খাতকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এটি কেবল আমাদের দাবি নয়, গোটা জাতির দাবি।” পরবর্তী কর্মসূচি হিসেবে তিনি জানান, “আগামীকাল থেকে কাস্টমস এজেন্ট কর্মচারীরা প্রতিদিন চার ঘণ্টা প্রতীকী কর্মবিরতি পালন করবেন। আমরা সরকারকে এক সপ্তাহ সময় দিচ্ছি। এই সময়ের মধ্যে দাবি পূরণ না হলে চট্টগ্রাম বন্দর সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেওয়া হবে।”
দুর্বল অর্থনীতির সময়েই কেন মাশুল বাড়ানো হলো ?
দেশের অর্থনীতি যখন চাপের মধ্যে, রপ্তানিকারকেরা টিকে থাকার লড়াইয়ে ব্যস্ত—ঠিক সেই সময় চট্টগ্রাম বন্দরের মাশুল বাড়ানোর সিদ্ধান্তে ক্ষোভ ছড়িয়েছে ব্যবসায়ী মহলে। অর্থনীতিবিদরাও প্রশ্ন তুলেছেন, এখন কেন এই বাড়তি চাপ?
বন্দর ব্যবহারকারীদের অভিযোগ, নতুন ট্যারিফ কাঠামো মূলত বিদেশি অপারেটরদের সুবিধা দিতে প্রণয়ন করা হয়েছে। তারা জানান, বেসরকারি বা বিদেশি অপারেটরদের হ্যান্ডলিং কার্যক্রম—যেমন ক্রেন অপারেশন, কনটেইনার লোড-আনলোড, স্টোরেজ, রিফার প্লাগ-ইন ও কনটেইনার চলাচল—এর ট্যারিফ গড়ে ১৪৪ শতাংশ বেড়েছে। এর তুলনায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (সিপিএ) নিজস্ব সেবার চার্জ—যেমন পাইলটেজ, নেভিগেশন ও নদী শুল্ক—প্রায় ৭০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
ব্যবসায়ীরা আরও বলছেন, বন্দরের অনেক চার্জই নির্ধারণ করা হয় মার্কিন ডলারে। ফলে টাকার মান কমে যাওয়ায় খরচ স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে গেছে। ২০২০ সালে এক ডলার সমান ছিল ৮৫ টাকা, তখন এক টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডলিং খরচ পড়ত ৪৩ ডলার বা প্রায় ৩,৬৫৫ টাকা। ২০২৪ সালে ডলারের দর ১২৪ টাকায় পৌঁছালে একই খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ৫,৩৩২ টাকা। অর্থাৎ শুধু বিনিময় হার পরিবর্তনের কারণেই ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৪৫ শতাংশ। একজন বন্দর ব্যবহারকারী বলেন, “মুদ্রা বিনিময়ের ওঠানামার কারণেই খরচ অনেক বেড়ে গেছে। এর ওপর নতুন করে ট্যারিফ বাড়ানো ব্যবসায়ীদের জন্য আরও বড় ধাক্কা।”
সরবরাহ শৃঙ্খলের ব্যাঘাত গভীরতর হচ্ছে:
দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরে চলমান অস্থিরতার মাঝেই এসেছে সাম্প্রতিক ট্যারিফ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত। সপ্তাহের শুরুতে পরিবহন ধর্মঘট এবং শুল্ক এজেন্টদের কর্মবিরতি এরমধ্যেই বন্দর কার্যক্রমের গতি ধীর করে দিয়েছে।
বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক বেলায়েত হোসেন বলেন, “পোশাক শিল্প টাইট শিডিউলে চলে। কাঁচামাল বহনকারী একটি কনটেইনার একদিনও দেরী হলেও – মালিকদের শ্রমিকদের মজুরি দিতেই হয়। সময় পুষিয়ে নিতে অনেক সময় ছুটির দিনেও অতিরিক্ত মজুরি দিয়ে কারখানা চালাতে হয় — যা সরাসরি আর্থিক ক্ষতি।”
সিসিসিআই -এর সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ বলেন, মাত্র চার দিনের ব্যবধানে কনটেইনার ডেলিভারি ৪৫ শতাংশ হ্রাস পাওয়া “অর্থনীতিতে অপূরণীয় ক্ষতি” ডেকে এনেছে। তিনি বলেন, “এই অচলাবস্থা আমদানি করা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়াবে এবং রপ্তানিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। যে সমস্যা ১২ ঘণ্টায় সমাধান করা যেত, সেটি হয়েছে চার দিনে, আমলাতান্ত্রিক অদক্ষতা ও সিদ্ধান্তহীনতার কারণে। আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি বন্দর এভাবে চলতে পারে না।”
যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (সিপিএ) সচিব ওমর ফারুক পরিবহন ধর্মঘটের কারণে “কিছু প্রভাব” স্বীকার করলেও দাবি করেন, সামগ্রিকভাবে বন্দরের কার্যক্রম তেমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। তিনি বলেন, “বন্দরের সম্প্রসারিত হ্যান্ডলিং সক্ষমতা আমাদের পরিস্থিতি সামাল দিতে সহায়তা করেছে।