মার্কিন বাজারে বাড়তি শুল্ক আর উৎপাদন ব্যয়ের চাপে চীনের তৈরি পোশাক খাত এখন নতুন আশ্রয় খুঁজছে — আর সেই নতুন গন্তব্য হয়ে উঠছে বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে চীনের বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক (RMG) খাতে ক্রমশ বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন, যা দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে নতুন মাত্রা দিয়েছে।
বিজিএমইএ’র তথ্যমতে, গত এক বছরে বাংলাদেশের অন্তত ২০টির বেশি পোশাক কারখানায় চীনা বিনিয়োগ এসেছে। কারও কেউ নতুন কারখানা গড়ে তুলছেন, আবার কেউ বন্ধ বা দুর্বল কারখানা লিজ নিয়ে উৎপাদন শুরু করছেন। এতে নির্মাণ খরচ কমছে, দ্রুত উৎপাদনে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে। ঢাকায় ইতোমধ্যেই বেশ কিছু চীনা ব্র্যান্ড ও বায়িং হাউজ তাদের লিয়াজোঁ অফিস খুলে ফেলেছে।
চীনে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে, শ্রমিক ব্যয়ও অনেক বেশি। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে তাদের পোশাক রপ্তানিতে শুল্কহার প্রায় ৫০ শতাংশ — যেখানে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতে গড়ে ৩৬ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ব্যবধানই চীনা উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে টেনে আনছে।
বাংলাদেশের তুলনামূলক কম উৎপাদন ব্যয়, দক্ষ শ্রমশক্তি, এবং ইউরোপীয় বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার—সব মিলিয়ে বাংলাদেশের পোশাক খাত এখন চীনা বিনিয়োগকারীদের কাছে বেশ আকর্ষণীয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, শুধু ২০২৫ সালের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে চীন থেকে এসেছে ৫৩ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ, যার মধ্যে ৩০ মিলিয়ন ডলারই টেক্সটাইল খাতে।
বাংলাদেশের অন্যতম বড় পোশাক রপ্তানিকারক মাহমুদ গ্রুপের একটি কারখানা, যা কয়েক মাস ধরে বন্ধ ছিল, সেটি সম্প্রতি এক চীনা কোম্পানি লিজ নিয়ে আবারও চালু করেছে।
মাহমুদ গ্রুপের এক কর্মকর্তা জানান, “চীনা বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানটি কারখানায় কার্যকর মূলধন দিয়েছে এবং বিপণনের দায়িত্বও নিয়েছে।”
অন্যদিকে বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, মাসকট গ্রুপের তিনটি কারখানা বিক্রির বিষয়ে এক চীনা কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা চলছে।
আর্থিক সংকটে শ্রমিকদের বেতন দিতে না পারায় কারখানাটি বিক্রির পথে হাঁটছে।
বাংলাদেশ–চীন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিসিআই) সভাপতি খোরশেদ আলম জানান, “গত দুই মাসেই চীনের অন্তত তিনটি টেক্সটাইল মিল বাংলাদেশে উলেন স্পিনিং ও ম্যান-মেড ফাইবার মিল স্থাপনের আগ্রহ দেখিয়েছে।”
তিনি বলেন, “চীনের তুলনায় বাংলাদেশে শ্রম সহজলভ্য এবং উৎপাদন খরচ কম—এটাই তাদের প্রধান আকর্ষণ।”
চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন সম্প্রতি ঢাকায় জানান, নতুন চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশে প্রায় ৮০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের অঙ্গীকার করেছে। এর মধ্যে চীনের ফ্যাশন জায়ান্ট সোহো ফ্যাশন গ্রুপ ইতোমধ্যেই ঢাকায় তাদের প্রতিনিধি অফিস চালু করেছে।
সোহো গ্রুপের চেয়ারম্যান লি ইয়ানজো বলেন, “বাংলাদেশ একটি দ্রুতবর্ধনশীল বাজার। এখানে উপস্থিতি বাড়াতে পেরে আমরা উচ্ছ্বসিত এবং বৈশ্বিক অংশীদারদের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে এগোতে চাই।”
বেপজার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে ২৪টি চীনা কোম্পানি জমি লিজের চুক্তি করেছে, যার মধ্যে ১০টি পোশাক ও টেক্সটাইল খাতের।
এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে—হোম জয় সকস, জিংচেন টেক্সটাইল, চিক উইংস ইনটিমেটস, বাংলাদেশ বাওরুই টেক্সটাইল, আইএন বাটন, এবং সেফটি গার্মেন্টস বিডি।
এছাড়া, হংকংভিত্তিক হানদা ইন্ডাস্ট্রিজ বাংলাদেশে ২৫০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে।
বিডার হিসাবে, ২০২৫ সালের প্রথম আট মাসে বাংলাদেশে আসা মোট বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রস্তাবের ২০ শতাংশই এসেছে চীন থেকে—যা কোনো একক দেশের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ।
ইপিজেড অঞ্চলের বাইরে সম্প্রতি আরও আটটি নতুন চীনা কোম্পানি পোশাক ও টেক্সটাইল খাতে বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে চুনই টেক্সটাইল, ট্রিসেন সোয়েটার, লোটাস কমার্স, বিএসএন বাংলাদেশ ট্রেডিং কোম্পানি ও বিগ সানশাইন (বিডি) ওপিসি।
অর্থনীতিবিদ মোস্তফা আবিদ খান মনে করেন, “চীনের বিনিয়োগ বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক। এতে নতুন কর্মসংস্থান ও প্রযুক্তি উভয়ই আসবে।”
তিনি বলেন, “চীন অনেক দিন ধরেই উৎপাদন অন্য দেশে সরিয়ে নিচ্ছে। ভিয়েতনামের পর বাংলাদেশ এখন তাদের প্রধান বিকল্প।”
তবে স্থানীয় উদ্যোক্তারা কিছুটা সতর্ক। বিজিএমইএ’র ইনামুল হক বাবলু বলেন, “আমরা চাই চীনা বিনিয়োগকারীরা বেসিক গার্মেন্টস নয়, বরং যেখানে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে—সেই খাতগুলোতে বিনিয়োগ করুক।”
বিসিসিসিআই সভাপতি খোরশেদ আলম আরও বলেন, “বর্তমানে গ্যাস সংকট একটি বড় সমস্যা। তাই নতুন কারখানার বদলে বিদ্যমান বন্ধ কারখানাগুলোয় যৌথ উদ্যোগে বিনিয়োগ করাই বাস্তবসম্মত হবে।”
চীনের রপ্তানি বাজারে সংকোচন আর যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ শুল্ক—সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এখন তাদের জন্য এক সম্ভাবনাময় আশ্রয়স্থল।
আর বাংলাদেশের জন্য, এই বিনিয়োগ প্রবাহ হতে পারে শিল্পখাতে নতুন প্রাণসঞ্চার ও কর্মসংস্থানের এক নতুন অধ্যায়।

