বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা ক্রমেই ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। নতুন তথ্য বলছে, রাজধানী ঢাকা জেলার মানুষের মাথাপিছু আয় এখন ৫ হাজার ১৬৩ ডলার—যা জাতীয় গড় ২ হাজার ৮২০ ডলারের প্রায় দ্বিগুণ। এই বৈষম্য দেশের উন্নয়ন কাঠামোতে এক নতুন প্রশ্ন তুলেছে: প্রবৃদ্ধি কি সমানভাবে ছড়াচ্ছে, নাকি কেবল রাজধানীতে সীমাবদ্ধ হচ্ছে?
শনিবার প্রকাশিত ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)-এর ‘ইকোনমিক পজিশন ইনডেক্স (ইপিআই)’ প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে আসে। সংগঠনটি জানিয়েছে, ২০১১ সালের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) তথ্যকে ভিত্তি ধরে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী এ আয় নির্ধারণ করা হয়েছে।
অন্যদিকে, চলতি বছরের মে মাসে বিবিএস জানিয়েছিল, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের গড় মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ইতিহাসের সর্বোচ্চ ২ হাজার ৮২০ ডলারে। আগের অর্থবছরে আয় ছিল ২ হাজার ৭৩৮ ডলার; অর্থাৎ এক বছরে বেড়েছে ৮২ ডলার।
তবে জেলা ভিত্তিক আয়ের কোনো আনুষ্ঠানিক হিসাব আগে প্রকাশ করেনি বিবিএস। তাই ডিসিসিআইয়ের এই বিশ্লেষণ প্রথমবারের মতো ঢাকাকেন্দ্রিক আয়ের চিত্র তুলে ধরল।
ডিসিসিআইয়ের তথ্যানুসারে, দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪৬ শতাংশই আসে ঢাকা থেকে। কর্মসংস্থানের ৪০ শতাংশও এখানেই।
সংগঠনটির ভাষ্য, রাজধানী দেশের বাণিজ্য, উৎপাদন ও সেবা খাতের প্রধান চালিকাশক্তি।
গবেষণাটি পরিচালিত হয় ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে। এতে উৎপাদন খাতের ৩৬৫ জন ও সেবা খাতের ২৮৯ জন উদ্যোক্তার সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব একেএম আসাদুজ্জামান পাটোয়ারী, সভাপতিত্ব করেন ডিসিসিআই সভাপতি তাসকীন আহমেদ।
উন্নয়ন বৈষম্যের সম্ভাব্য ইঙ্গিত
অর্থনীতিবিদদের মতে, ঢাকার এমন উচ্চ আয়ের পরিসংখ্যান উন্নয়নের কেন্দ্রীকরণ ও আঞ্চলিক বৈষম্যের ইঙ্গিত বহন করে। দেশের মোট রপ্তানির ৪০ শতাংশই আসে ঢাকাকেন্দ্রিক অঞ্চল থেকে। একই সঙ্গে এখানে দেশের মোট জনসংখ্যার ১১ দশমিক ২ শতাংশ এবং শহুরে জনসংখ্যার ৩২ শতাংশের বসবাস—যা এশিয়ার মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ ঘনবসতি।
এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে, দেশের অন্যান্য অঞ্চলে শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানের বিস্তার কতটা ঘটছে? ঢাকায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়লেও অন্য জেলাগুলো পিছিয়ে থাকলে সামগ্রিক উন্নয়নে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
ঢাকাকেন্দ্রিক প্রবৃদ্ধি: সুযোগ নাকি চ্যালেঞ্জ?
ডিসিসিআই বলছে, ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণের অংশ হিসেবে এই গবেষণা পরিচালিত হয়। এতে দেখা গেছে, ঢাকায় বাণিজ্য, উৎপাদন ও সেবা খাতে দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটছে।
তবে অর্থনীতিবিদদের মতে, এই প্রবণতা একদিকে যেমন দেশের প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করছে, অন্যদিকে তা আঞ্চলিক ভারসাম্যহীনতার ঝুঁকিও বাড়াচ্ছে।
অর্থনৈতিক কার্যক্রম যখন রাজধানী ও আশপাশে কেন্দ্রীভূত হয়, তখন অবকাঠামোগত চাপ, নগরজট এবং জীবনযাত্রার ব্যয়ও বেড়ে যায়—যা টেকসই উন্নয়নের পথে বাধা তৈরি করতে পারে।
সামনে কী অপেক্ষা করছে?
ঢাকার উচ্চ মাথাপিছু আয় নিঃসন্দেহে দেশের অর্থনৈতিক সামর্থ্যের প্রতিচ্ছবি। তবে এই প্রবৃদ্ধি সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে না পারলে আঞ্চলিক উন্নয়নের ভারসাম্যহীনতা বাড়বে—যা ভবিষ্যতে সামাজিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ডেকে আনতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এখন সময় এসেছে “ঢাকা থেকে উন্নয়ন ছড়িয়ে দেওয়ার”। সমন্বিত নীতি গ্রহণের মাধ্যমে শিল্প ও বিনিয়োগ অন্যান্য জেলায় স্থানান্তর করা গেলে জাতীয় প্রবৃদ্ধি আরও টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে।

