সবার জন্য আবাসন’ স্লোগানকে বাস্তবে রূপ দিতে বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (বিএইচবিএফসি) দীর্ঘদিন ধরে প্রচার চালাচ্ছে। দেশের গৃহঋণ বিতরণে প্রতিষ্ঠানটি অগ্রণী হলেও সম্প্রতি তহবিলসংকটের কারণে অনুমোদন পাওয়া সত্ত্বেও সব আবেদনকারীর চাহিদা পূরণ করতে পারছে না।
গত অর্থবছরে বিএইচবিএফসি ১ হাজার ৩ কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর করেছে। তবে বাস্তব বিতরণ হয়েছে ৯২১ কোটি টাকা, যা পূর্ববর্তী অর্থবছরের ৯১২ কোটি টাকার তুলনায় সামান্য বেশি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। বিএইচবিএফসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুল মান্নান বলেন, ‘বিভিন্ন ব্যাংকের সুদের হার বেশি হওয়ায় আমাদের ঋণের চাহিদা বাড়ছে। সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ৫ শতাংশ সুদের ঋণের চাহিদাও বেশি। সব চাহিদা মেটানো এখন সম্ভব হচ্ছে না। তবে শরিয়াভিত্তিক তহবিল থেকে চাহিদা অনুযায়ী সবাইকে ১০০ শতাংশ ঋণ দেওয়া যায়। ঋণ অনুমোদনের সময় বলা হয় কোনটা শরিয়াভিত্তিক, আর কোনটা সরকারি তহবিলের। এ দুটি আলাদা ব্যবস্থায় পরিচালিত হয়।’
ঢাকা ও চট্টগ্রামে হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন ১০ শতাংশ সুদে ঋণ দিচ্ছে। অন্যান্য জেলায় সুদের হার ৯ শতাংশ। আগে এটি কম ছিল, কিন্তু চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সুদ বেড়েছে। ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইএসডিবি) থেকে পাওয়া তহবিলের মাধ্যমে ঋণ দেওয়া হচ্ছে। এই তহবিল থেকে চার বছর পর্যন্ত অর্থ ছাড় পাওয়া যাবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কম সুদে সহজে ঋণ দেয়ার বার্তা প্রচার হওয়ায় চাহিদা আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সব রেকর্ড ভেঙে ১ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর হয়েছে। এর মধ্যে বিতরণ হয়েছে ৯১২ কোটি টাকা। তহবিলসংকটের কারণে সবার চাহিদা পূরণ করা যায়নি। স্বাধীনতার পর গত জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন খাতে ঋণ বিতরণ হয়েছে ১০,৫৮৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকার, যা ২,৬০,১১৬ ইউনিটে পৌঁছেছে। গ্রাহকরা নিজের অভিজ্ঞতা জানাচ্ছেন। ধানমন্ডি শাখার মো. ফারুক আলম বলেন, ‘অনেক কাগজপত্র জমা দেওয়ার পর ১৮ লাখ টাকা ঋণ মঞ্জুর হয়েছে। বারবার যোগাযোগ করে কিস্তির টাকা পেয়েছি।’
গভীর তহবিলসংকটের কারণে শাখা কর্মকর্তারা সীমিত ঋণ দিতে বাধ্য। গুলশান শাখার ম্যানেজার আ. করিম বলেন, ‘সব কাগজপত্র ঠিক থাকলে ঋণ মঞ্জুর হয় কিন্তু এখন সবাইকে আগের মতো ঋণ দেওয়া সম্ভব নয়। গত বছর থেকেই তহবিলসংকট চলছে। তাই কার্যক্রম সেভাবেই চলছে।’ সরকারের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের আওতায় পরিচালিত বিএইচবিএফসি নিট মুনাফার ২ শতাংশ সরকারি কোষাগারে জমা রাখতো। তবে গত বছর এটি ৫০ শতাংশে বৃদ্ধি করা হয়েছে। এতে তহবিল সংকট দেখা দিয়েছে। এডিবি থেকে তহবিল পাওয়া গেলেও পুরো অর্থ এখনও আসেনি। তাই কিস্তি আকারে ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকারের ‘সবার জন্য আবাসন’ উদ্যোগ কার্যকর করতে বিএইচবিএফসি বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ঋণ বিতরণ করছে। সাবেক এমডি দেবাশীষ চক্রবর্তী ফ্ল্যাট ঋণ, নগরবন্ধু, প্রবাসবন্ধু, ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন, আবাসন উন্নয়ন, আবাসন মেরামত, কৃষক আবাসন, সরকারি কর্মচারী আবাসন ও হাউসিং ইকুইপমেন্ট প্রকল্পে ঋণ বিতরণ শুরু করেন। পরবর্তীতে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট মহানগর এলাকার বাইরে ‘মনজিল’ এবং উন্নত ও উন্নয়নশীল এলাকার জন্য ‘স্বপ্ননীড়’ প্রকল্পে ঋণ বিতরণ করা হয়।
নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর জন্য টেকসই ও পরিবেশবান্ধব আবাসন নির্মাণে প্রায় ৩,২০০ কোটি টাকার দ্বিতীয় পর্যায়ের তহবিল দিতে ২০২৪ সালের ২৯ এপ্রিল আইএসডিবির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে বিএইচবিএফসি। প্রথম দফার ৭০০ কোটি টাকার তহবিল পুরোপুরি বিতরণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে অর্থ ছাড় দেরিতে হওয়ায় ঋণ বিতরণে সংকট দেখা দিয়েছে। শরিয়াভিত্তিক এই তহবিল থেকে মঞ্জিল প্রকল্পে গত অর্থবছরে ৬১৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হয়। সরকারি তহবিল থেকে ৩০৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, দেশের গৃহায়ণ সমস্যা সমাধানে ১৯৫২ সালে হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রপতির ৭ নম্বর আদেশে পুনর্গঠিত হয়। প্রতিটি অর্থবছরে ঋণের চাহিদা বেড়েই চলেছে। সর্বশেষ অর্থবছরে ১ লাখ ২৪,৯৮৭টি আবেদনের বিপরীতে ১০,৫৮৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে।

