একসময় পণ্য ও কাঁচামাল আমদানিতে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের প্রথম পছন্দ ছিল ভারত। কিন্তু বিশ্ব বাণিজ্যের নতুন সমীকরণে সেই অবস্থান বদলে গেছে। গত দেড় যুগে বাংলাদেশ খুঁজে নিয়েছে নতুন গন্তব্য—চীন। এখন দেশের সবচেয়ে বড় আমদানির উৎস এই দেশটিই।
চীনা পণ্যের সহজলভ্যতা, সাশ্রয়ী মূল্য ও মানের কারণে বাংলাদেশে দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আজ দেশের প্রায় প্রতিটি ঘরে—সুঁই থেকে রেফ্রিজারেটর পর্যন্ত—চীনের কোনো না কোনো পণ্য আছে। এমনকি দেশের উৎপাদনশীল খাতের কাঁচামালও অনেকাংশে আসে চীন থেকে।
বাণিজ্যের পালা বদল
বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, ২০০৮–০৯ অর্থবছরে চীন থেকে ৩৪১ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছিল বাংলাদেশ। তখন চীনে রপ্তানি ছিল মাত্র ১০ কোটি ডলারের মতো।
কিন্তু ২০২৪–২৫ অর্থবছরে দুই দেশের বাণিজ্য বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৩৫ কোটি মার্কিন ডলারে। এর মধ্যে চীন থেকে আমদানি ১ হাজার ৬৬৪ কোটি ডলার এবং রপ্তানি মাত্র ৭১ কোটি ৫৩ লাখ ডলার।
২০২৩–২৪ অর্থবছরে এই পরিমাণ ছিল ২ হাজার ১৮০ কোটি ডলার, আর ২০২২–২৩ সালে ১ হাজার ৮৫০ কোটি ডলার।
অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতি যত বড় হচ্ছে, চীনের সঙ্গে বাণিজ্য তত বাড়ছে। আমদানিনির্ভর খাতগুলোতে চীনের ভূমিকা এখন ‘অপরিহার্য’।
খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান—সবখানেই চীনের ছোঁয়া
বাংলাদেশ এখন খাদ্য থেকে শুরু করে শিক্ষা, চিকিৎসা—সব মৌলিক খাতেই চীননির্ভর। আগে ভারত থেকে সবচেয়ে বেশি খাদ্যপণ্য আমদানি হতো, এখন তার বড় অংশই আসে চীন থেকে।
চীনা যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি দেশীয় খাদ্যশিল্পে বড় ভূমিকা রাখছে। সার, কীটনাশক ও কৃষিপণ্য উৎপাদনের অনেক কাঁচামালও চীন থেকেই আসে।
রপ্তানিনির্ভর পোশাকশিল্পে চীনের অবদান আরও বড়। এ শিল্পের ৮০ শতাংশ কাঁচামাল চীন থেকে আমদানি হয়। একইভাবে নির্মাণসামগ্রী, ইলেকট্রনিক পণ্য, এমনকি কাগজ, ছাপার কালি ও শিক্ষাসামগ্রীর প্রধান উৎসও চীন।
সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন,
“পণ্য, কাঁচামাল ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে চীনের বিকল্প এখন বাংলাদেশের হাতে নেই। ব্যবসায়ীদের জন্য এই সোর্স সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী।”
২০২৩–২৪ অর্থবছরে চীন থেকে আমদানি করা খাদ্যপণ্যের মূল্য ছিল এক লাখ ২৬ হাজার ২৪১ কোটি টাকা—মোট আমদানির ২৩ শতাংশ। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ভারত থেকে এসেছে ৫৬ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকার খাদ্যপণ্য।
ব্যবসায়ীদের দৃষ্টি চীনের দিকে
বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বাশার চৌধুরী বলেন,
“ব্যবসায়ীরা সবসময় নির্ভরযোগ্যতা চান। চীনে এলসি করে ঠিকঠাক পণ্য পাওয়া যায়, দামও ভালো থাকে। তাই ব্যবসায়ীরা চীনের ওপরই আস্থা রাখেন।”
মসলাজাতীয় পণ্যের আমদানিকারক আব্দুল মাজেদ যোগ করেন,
“চীন থেকে শুধু আদা-রসুনের পরিমাণই বিপুল। পরিবহন খরচও তুলনামূলক কম, ঝুঁকিও কম।”
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আহমেদ ফয়সল ইমাম জানান,
“চীন সার আমদানির জন্য নির্ভরযোগ্য দেশ। বাংলাদেশ কয়েক বছর ধরে সেখান থেকেই বেশি সার আনছে।”
দেশে আমদানি হওয়া কীটনাশক ও কাঁচামালের অর্ধেকের বেশি চীনের।
পোশাকশিল্পে ৮০ শতাংশ কাঁচামাল চীন থেকে
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, পোশাকশিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামালের ৮০ শতাংশই আসে চীন থেকে। নিট পোশাকে ব্যবহৃত রাসায়নিক ও এক্সেসরিজেরও বড় অংশ চীনা পণ্য।
বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান বলেন,
“আমাদের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ দুর্বল। কৃত্রিম সুতা ও কাপড়ের বিকল্প পাওয়া যায় না। তাই এ খাত যত বাড়ছে, চীনের ওপর নির্ভরতা তত বাড়ছে।”
নির্মাণশিল্পেও চীনের প্রভাব
দেশের সিমেন্ট, ইস্পাত, টাইলস, মার্বেল ও নির্মাণ উপকরণের বাজারেও চীনের প্রভাব স্পষ্ট।
২০২৩–২৪ অর্থবছরে ক্লিংকার আমদানি হয়েছে দুই কোটি পাঁচ লাখ টন, যার ৩৫ শতাংশই চীনের। কয়লা, পাথর, এমনকি ইট তৈরির উপকরণও চীন থেকে আসে।
প্রিমিয়ার সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক বলেন,
“সিমেন্টের পাঁচটি প্রধান কাঁচামালের বেশিরভাগই আমদানিনির্ভর, যার বড় উৎস চীন।”
শিক্ষা ও ওষুধেও চীনা নির্ভরতা
বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১০ লাখ টন কাগজের চাহিদা আছে। এসব কাগজ তৈরির পাল্প ও ভারী কাগজের বেশিরভাগই চীন থেকে আসে।
আম্বার পেপার মিলসের পরিচালক আখতারুজ্জামান জানান, ৮০টিরও বেশি কারখানা পাল্প আমদানির জন্য চীনের ওপর নির্ভর করে।
একইভাবে ওষুধশিল্পও চীননির্ভর। দেশের বাজারের আকার ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়ালেও কাঁচামালের ৯৭ শতাংশ আসে বিদেশ থেকে, যার ৫০–৬০ শতাংশ চীনের।
বাংলাদেশ ওষুধশিল্প সমিতির মহাসচিব মো. জাকির হোসেন বলেন,
“আমরা ফরমুলেশনে এগিয়েছি, কিন্তু এপিআই সক্ষমতা কম। চীন আমাদের ব্যাকআপ দিচ্ছে। সবচেয়ে সাশ্রয়ী উৎসও ওরা।”
দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত অংশীদার
১৯৭৫ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর থেকেই চীন বাংলাদেশের বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।
অধ্যাপক ড. সাহাবুল হক বলেন,
“চীন ব্যবসাকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয়। কোনো ভূ-রাজনৈতিক টানাপোড়েন কখনো হয়নি। তাই বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা তাদের ওপর আস্থা রাখেন।”
ভারতের সঙ্গে তুলনা টেনে তিনি বলেন,
“প্রতিবেশী হলেও ভারতের সঙ্গে ব্যবসায়িক টানাপোড়েন ঘটে, কখনো শুল্ক বাড়ানো হয়, কখনো নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু চীনের ক্ষেত্রে এমন কিছু হয়নি।”
ব্যবসার পাশাপাশি সরকার পর্যায়েও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ়।
চীনা কোম্পানিগুলো পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক, পায়রা বন্দর, কর্ণফুলী টানেলসহ অনেক বড় প্রকল্পে যুক্ত।
বর্তমানে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) এবং বিসিআইএম করিডোরের আওতায় বাংলাদেশের ৩০টিরও বেশি প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগ রয়েছে।
অর্থনীতিবিদদের হিসাবে, দেশে চীনা বিনিয়োগের পরিমাণ এখন এক হাজার কোটি ডলারের বেশি।

