বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত এখন এক অস্বস্তিকর প্রতিযোগিতায় আটকে গেছে; কে কত বেশি মুনাফা দেখাতে পারে, কে কত দ্রুত আমানত টানতে পারে, কে বেশি উচ্চ সুদে ঋণ দিতে পারে। এই প্রতিযোগিতায় সাময়িকভাবে শেয়ারহোল্ডাররা খুশি হলেও ভেঙে পড়ছে ব্যাংকিং শৃঙ্খলা, বাড়ছে অনিয়ম এবং নড়বড়ে হয়ে পড়ছে আর্থিক ব্যবস্থার ভিত। ব্যাংকের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত সঞ্চয়কে উৎপাদনশীল বিনিয়োগে রূপান্তর করা; কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে অনেক ব্যাংকই দ্রুত মুনাফার নেশায় এমন সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে যা ভবিষ্যতে আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য ভয়ংকর সংকেত দিচ্ছে।
উচ্চ মুনাফা অর্জনের এই দৌড়ে ব্যাংকিং শৃঙ্খলার ধ্বস শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, সাধারণ মানুষ ও বিনিয়োগকারীদের আস্থাকেও শিথিল করছে। বর্তমান প্রতিবেদনে আমরা এই বিষয়টি বিশ্লেষণ করে দেখব যে, কীভাবে উচ্চ মুনাফার প্রতিযোগিতা ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলাভঙ্গের প্রবণতা বাড়াচ্ছে এবং এর সম্ভাব্য প্রভাব ও সমাধানের উপায় কী হতে পারে।
মুনাফার দৌড়ে অনিয়ন্ত্রিত প্রতিযোগিতা: বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান- ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর অনুযায়ী, দেশের ৬২টি ব্যাংকের মধ্যে অন্তত ১৮টি ব্যাংক গত এক বছরে মুনাফা বাড়াতে গিয়ে উচ্চ সুদে ঋণ বিতরণ ও উচ্চ রেটে আমানত সংগ্রহে ঝুঁকেছে। এই ব্যাংকগুলোর মধ্যে কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক গত বছরের তুলনায় ২৫–৩০% পর্যন্ত মুনাফা বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে।তবে এই তথাকথিত মুনাফা এসেছে উচ্চঝুঁকিপূর্ণ ঋণ ও অস্বাভাবিক আমানত খরচ থেকে।
উদাহরণ স্বরূপ-২০২৫ সালের মধ্যভাগে কয়েকটি নতুন প্রজন্মের বেসরকারি ব্যাংক ১১–১২% পর্যন্ত স্থায়ী আমানতের সুদ ঘোষণা করে। একই সময়ে সরকারি ব্যাংকগুলোর গড় সুদ ছিল ৮–৯%।ফলে ছোট ব্যাংকগুলোও টিকে থাকার তাগিদে সুদ প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। এই অস্থির প্রতিযোগিতা শেষ পর্যন্ত ব্যাংক খাতের লিকুইডিটি সংকট বাড়িয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটি এক ধরণের “মুনাফা-নির্ভর অস্থিরতা”, যেখানে স্বল্পমেয়াদি লভ্যাংশের জন্য ব্যাংকগুলো দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা বিসর্জন দিচ্ছে।
সুদ প্রতিযোগিতা থেকে অযৌক্তিক ঋণ অনুমোদন: সুদ প্রতিযোগিতার ফলেই এখন অনেক ব্যাংক ঝুঁকিপূর্ণ খাতে ঋণ দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ নীতিমালা অনুযায়ী, বড় ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে যথাযথ জামানত ও ক্রেডিট রিস্ক বিশ্লেষণ বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, দ্রুত মুনাফা দেখানোর জন্য অনেক ব্যাংক এখন ‘ক্রেডিট স্কোর’ যাচাই ছাড়াই ঋণ অনুমোদন দিচ্ছে।
২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী- দেশের মোট অনুৎপাদনশীল ঋণ (NPL) দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ৮৭ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ১০ দশমিক ৩ শতাংশ।এর মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর অনুৎপাদনশীল ঋণ ৭৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। একজন সিনিয়র ব্যাংক নির্বাহী নাম প্রকাশ না করার শর্তে মন্তব্য করেন, “মুনাফার লক্ষ্য পূরণের চাপ এত বেশি যে, এখন বোর্ড সভায় লাভ-ক্ষতির হিসাব আগে আলোচিত হয়, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা পরে।” এই মন্তব্যই প্রমাণ করে ব্যাংকিং খাত এখন “বাজার-নির্ভর শৃঙ্খলার” বদলে “মুনাফা-নির্ভর বিশৃঙ্খলায়” পড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে সীমাবদ্ধতা: বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৫ সালে ধারাবাহিকভাবে নীতিসূদ ৮% বজায় রাখলেও, বাজারে কার্যত এর প্রভাব ক্ষীণ। কারণ বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বেশিরভাগই নীতিসূদের ঊর্ধ্বে আমানত ও ঋণ রেট নির্ধারণ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, “নীতিসূদ নির্ধারণের মাধ্যমে বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করা এখন কঠিন; ব্যাংকগুলো একধরণের নিজস্ব বাজার তৈরি করেছে যেখানে নিয়ন্ত্রক প্রভাব সীমিত।”
অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান মনে করেন, “এটি মূলতঃ নীতি ও বাজারের মধ্যে আস্থাহীনতার প্রতিফলন। যখন বাজার বিশ্বাস করে না যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারবে, তখনই অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে।” বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নীতিসুদ, নগদ সংরক্ষণ হার (CRR) বা ঋণ-আমানত অনুপাত (ADR) নির্ধারণ করেও বাজারের মুনাফা-উন্মত্ততা ঠেকানো যাচ্ছে না। ফলে এখন প্রয়োজন ‘স্ট্রাকচারাল ডিসিপ্লিন’, যা ব্যাংক পরিচালনা, তদারকি ও বোর্ড সংস্কৃতিতে প্রতিফলিত হবে।
ব্যাংক পরিচালনায় গোষ্ঠী স্বার্থ ও নৈতিক অবক্ষয়: বাংলাদেশের কিছু ব্যাংক এখন বোর্ড পর্যায়ে গোষ্ঠীগত প্রভাবের শিকার। পারিবারিক, রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক স্বার্থের সংঘাতে ব্যাংক পরিচালনা হারাচ্ছে পেশাদারিত্ব। গত এক বছরে কয়েকটি ব্যাংকের বোর্ডে দেখা গেছে, একই পরিবারের সদস্যরা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ঋণ অনুমোদন প্রক্রিয়ায় স্বজনপ্রীতি ও পার্টি-লবিং প্রভাব ফেলছে।ফলে ব্যাংকগুলো ক্রমশ ‘প্রফেশনাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন’ থেকে ‘পার্সোনাল ইনফ্লুয়েন্স হাব’-এ পরিণত হচ্ছে। এটি নৈতিক অবক্ষয়ের ফল। ঋণ ফেরত না দিয়েও ‘পুনঃতফসিলের’ সুযোগ, ঘন ঘন লভ্যাংশ ঘোষণা দিয়ে বাজারে সুনাম দেখানোর প্রবণতা এবং বাস্তবে ‘ক্যাশ ফ্লো ক্রাইসিস’ তৈরি হওয়া। ২০২৫ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে অন্তত ৫টি ব্যাংক তাদের রিজার্ভ ঘাটতি পূরণে আন্তঃব্যাংক ঋণ নিয়েছে। অর্থাৎ মুনাফার কাগুজে হিসাবের আড়ালে লিকুইডিটি সংকট প্রকট হচ্ছে।
বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে এই হার কমানোর মূল উদ্দেশ্য হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা এবং আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য রক্ষা করা। সাম্প্রতিক বাজেট নীতিতে দেখা গেছে, সরকারি ঋণের ব্যয় ও সুদ পরিশোধের চাপ কমাতে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে এই সিদ্ধান্ত মধ্যবিত্ত ও প্রবীণ সঞ্চয়কারীদের জন্য একটি বড় আর্থিক চাপ তৈরি করেছে, কারণ তাদের সঞ্চয় থেকে প্রাপ্ত মাসিক আয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাচ্ছে।
২০২৫ সালের ১ জুলাই থেকে কার্যকর হওয়া নতুন হারের ফলে “পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র”- এর মুনাফার হার ১২ দশমিক ৪০ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৮৩ শতাংশে। একইভাবে “পেনশনার সঞ্চয়পত্র”-এর হার ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১১ দশমিক ৯৮ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এই পরিবর্তনটি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (IRD) কর্তৃক জারি করা প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কার্যকর করা হয়েছে, যা দেশের বিভিন্ন সঞ্চয় কর্মসূচির মুনাফার হার পুনর্বিন্যাসের অংশ।
নতুন নীতিতে সঞ্চয়কারীদের বিনিয়োগের পরিমাণ অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন মুনাফার হার নির্ধারণ করা হয়েছে। সাড়ে ৭ লাখ টাকার নিচে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পেনশনার সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার ছিল ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ, যা এখন কমে হয়েছে ১১ দশমিক ৯৮ শতাংশ। অন্যদিকে সাড়ে ৭ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মুনাফার হার ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৮০ শতাংশে। এই নতুন হার ২০২৫ সালের ১ জুলাই থেকে কার্যকর হয়েছে।
আস্থার সংকটে গ্রাহক ও আমানতকারী: এই পরিস্থিতিতে গ্রাহকদের মধ্যে এক ধরণের “ডিপোজিট অ্যানজাইটি” তৈরি হয়েছে।বিশেষ করে ডিজিটাল ব্যাংকিং, ফিনটেক প্ল্যাটফর্ম ও মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের প্রতি আকর্ষণ বাড়ছে। ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী- ব্যাংকিং খাতে মোট আমানত প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৮ দশমিক ৯%, অথচ মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (MFS) সেক্টরে লেনদেন বেড়েছে ২১ দশমিক ৭%। অর্থাৎ প্রচলিত ব্যাংক থেকে জনগণের আস্থা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে স্থানান্তরিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি “ট্রাস্ট মাইগ্রেশন”, যেখানে আস্থার কেন্দ্র ব্যাংক থেকে ডিজিটাল ফাইন্যান্সে স্থানান্তরিত হয়।
পুনর্গঠনের জন্য প্রয়োজন নীতি, নৈতিকতা ও নতুন নিয়ন্ত্রণ কাঠামো: ব্যাংকিং শৃঙ্খলা পুনর্গঠনের জন্য অর্থনীতিবিদরা তিনটি দিককে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন- শৃঙ্খলিত মুনাফা মডেল:ব্যাংককে দীর্ঘমেয়াদি পোর্টফোলিও মুনাফার দিকে যেতে হবে, তাৎক্ষণিক আয় নয়। নৈতিক পরিচালনা কাঠামো (Ethical Governance): বোর্ডে স্বচ্ছতা, স্বাধীনতা ও পেশাদারদের ভূমিকা জোরদার করতে হবে।আর সর্বশেষ ডিজিটাল স্বচ্ছতা ও তদারকি (Digital Oversight): রিয়েল-টাইম ডেটা শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রতিটি ব্যাংকের আর্থিক স্থিতি মনিটর করতে হবে। এছাড়া ব্যাংক খাতে স্বচ্ছতা আনতে “ইন্টারেস্ট রেট ক্যাপ” পুনর্বিবেচনা ও “রিস্ক-বেসড প্রফিট রিপোর্টিং” চালুর দাবি উঠছে। উপরোক্ত আলোচনা পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, মুনাফা নয়, আস্থা হোক ব্যাংকিংয়ের মেরুদণ্ড।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত যদি টেকসই হতে চায়, তবে তাকে স্বল্পমেয়াদি লাভের নেশা থেকে বেরিয়ে এসে দীর্ঘমেয়াদি আস্থার অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে।অন্যথায় আজকের কাগুজে মুনাফা আগামী দিনের আর্থিক সংকটের পূর্বাভাস হয়ে দাঁড়াবে।
যেভাবে ২০২৩–২৫ সালের মধ্যে আমানত হ্রাস, ঋণ খেলাপি বৃদ্ধি ও গ্রাহক আস্থার পতন ঘটেছে, তাতে স্পষ্ট, ব্যাংকিং শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার এখন আর কেবল নীতি নয়, এটি অর্থনৈতিক টিকে থাকার শর্ত। “ব্যাংক টিকবে তখনই, যখন আস্থা টিকবে।” এই কথাটিই আজ বাংলাদেশের আর্থিক খাতের জন্য সবচেয়ে বড় সতর্কবাণী।

