বছরের পর বছর ধরে চট্টগ্রাম বন্দরে পড়ে ছিল বিপজ্জনক কেমিক্যালে ভরা ৩২০টি কনটেইনার। এখতিয়ারবহির্ভূত হওয়ায় বন্দর কর্তৃপক্ষ সেগুলো ধ্বংস করতে পারছিল না। এতে কনটেইনারগুলোর জন্য বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। একদিকে নিরাপত্তার ঝুঁকি, অন্যদিকে ইয়ার্ডে জটের কারণে নতুন কনটেইনার রাখতেও সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছিল। এ কারণে প্রতি বছর প্রায় ৭৩০ কোটি টাকা রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছিল সরকার।
লেবাননের বৈরুত বন্দরে ২০২০ সালে বিস্ফোরক ভর্তি কনটেইনারে ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার সরানোর উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা কার্যকর হয়নি। চিঠিপত্রের চালাচালি ছাড়া প্রকৃত কোনো কাজ হয়নি। অবশেষে সম্প্রতি ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস থেকে পুনরায় উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর অংশ হিসেবে কয়েকদিন আগে দীর্ঘদিন ধরে বন্দরে পড়ে থাকা নিলাম অযোগ্য ১৯টি বিপজ্জনক কনটেইনার ধ্বংস করা হয়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গতকাল মঙ্গলবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ২৫ অক্টোবর সকাল ৯টা থেকে ২৬ অক্টোবর রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত ওই পণ্যগুলো ধ্বংস করা হয়। ধ্বংসকাজে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, আনসার সদস্য এবং স্থানীয় বন্দর থানা পুলিশের সহায়তা নেওয়া হয়। ধ্বংস হওয়া পণ্যের মধ্যে ছিল—আনকোটেড ক্যালসিয়াম কার্বোনেট ১৬ কনটেইনার, অরেঞ্জ ইমালশন ১ কনটেইনার, সুইট হুই পাউডার ১ কনটেইনার এবং স্কিমড মিল্ক পাউডার ১ কনটেইনার। কনটেইনারগুলো বহুদিন ধরে বন্দরে জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে ছিল এবং বন্দরের নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি তৈরি করছিল বলে এনবিআর জানিয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরে দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকা বিপজ্জনক কনটেইনার ধ্বংসের কাজ সম্পন্ন হয়েছে আন্তঃসংস্থা কমিটির তত্ত্বাবধানে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) জানিয়েছে, নিলাম অযোগ্য ও বিপজ্জনক পণ্য ধ্বংসের জন্য গঠিত এই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) মোহাম্মদ নূরুল্লাহ নূরী। কার্যক্রমে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ অধিদপ্তর, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, ডিজিএফআই, এনএসআই, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ এবং চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের প্রতিনিধি।
এর আগে, গত বছরের অক্টোবর মাসে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ যৌথভাবে চারটি অতি দাহ্য পণ্য ধ্বংস করেছিল, যা ১৪ বছর ধরে বন্দরে পড়ে ছিল। এনবিআর জানিয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দরের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সহযোগিতায় বিপজ্জনক পণ্যগুলো ধ্বংসের কাজ পর্যায়ক্রমে চলবে। খোঁজে জানা গেছে, চলতি বছর চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চিহ্নিত ৩৩৯টি বিপজ্জনক কনটেইনার ধ্বংসের জন্য তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে। এই কমিটি ২০১৯ সালের ১৫ জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের মধ্যে আমদানি হওয়া ৫৩টি কনটেইনার ধ্বংসের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেছিল। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষ কনটেইনারগুলো ধ্বংস করেনি। তাদের মতে, কাস্টমস আইন অনুযায়ী পণ্য ধ্বংস এবং নিলামের এখতিয়ার কেবল কাস্টম হাউসের। ফলে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের উদ্যোগ বন্দর কর্তৃপক্ষের কারণে আটকে যায়।
চট্টগ্রাম বন্দরে দীর্ঘদিন ধরে বিপজ্জনক কনটেইনার পড়ে থাকায় নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়ছে এবং হ্যান্ডলিং কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বন্দরের সূত্রে জানা গেছে, ইয়ার্ডে মোট ৫৩ হাজার ৫১৮ কনটেইনার সংরক্ষণ করা যায়। সাধারণত আমদানি করা পণ্য ৩০ দিন পর নিলামযোগ্য হয়। কিন্তু নিলামে দীর্ঘসূত্রতার কারণে বছরের পর বছর ধরে নিলামযোগ্য ৩৩৯টি কনটেইনার জমে আছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এসব কনটেইনার না থাকলে বছরে প্রায় ১ লাখ টিইউএস কনটেইনার বেশি হ্যান্ডলিং করা যেত। এছাড়া এসব কনটেইনারের কারণে বন্দরের সার্বিক কার্যক্রমও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বন্দর কর্তৃপক্ষের দাবি, দ্রুত নিলাম ডেকে কনটেইনারে থাকা বিপজ্জনক রাসায়নিক ধ্বংস করতে হবে। এই বিষয়ে তারা দফায় দফায় চিঠি দিয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক জানিয়েছেন, ইয়ার্ডে এখনও তিনশর বেশি বিপজ্জনক কনটেইনার পড়ে আছে। এসব কনটেইনারে দাহ্য পদার্থ রয়েছে। ধ্বংসযোগ্য কিছু কনটেইনারও রয়েছে, যা দ্রুত ধ্বংস করা উচিত। তাই কর্তৃপক্ষকে প্রতিনিয়ত বাড়তি সতর্কতা নিতে হচ্ছে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের গঠিত কমিটি ৫৩টি কনটেইনার ধ্বংসের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেছে। এর মধ্যে আছে—আনকোটেড ক্যালসিয়াম কার্বনেট পাউডার ১৬টি (২০১৭ সালে আমদানি), সোডিয়াম সালফেট ১৪টি (২০০৮ সালে আমদানি) এবং সোডিয়াম সালফেট ৮টি (২০১০ সালে আমদানি)। এছাড়া বিভিন্ন রাসায়নিক বোঝাই আরও কিছু কনটেইনারও ধ্বংসের জন্য হস্তান্তর করা হয়েছে।
রাসায়নিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্দরে বছরের পর বছর ধরে পড়ে থাকা এসব কনটেইনার দ্রুত ধ্বংস করা প্রয়োজন। নিলামে বা ধ্বংসে দেরি হলে নতুন কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তা সামাল দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। চট্টগ্রাম বন্দরে বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যালে ভর্তি কনটেইনার পড়ে রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল জব্বার বলেন, কিছু কেমিক্যাল একত্রে রাখা বিপজ্জনক। তাই এসব কনটেইনার সংরক্ষণ ও ধ্বংসের ক্ষেত্রে সঠিক নিয়ম অনুসরণ করা জরুরি। বিশেষ করে এই কেমিক্যালগুলো শিল্পায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, যেমন টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস খাতে ব্যবহার হয়।
ড. জব্বার বলেন, “বিপজ্জনক কেমিক্যাল ধ্বংসের ক্ষেত্রে একটি সংস্থা বা একজন কর্মকর্তা একা দায়িত্ব নিতে পারবে না। প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। কেমিস্ট থেকে শুরু করে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারসহ কেমিক্যাল বিষয়ে অভিজ্ঞদের নিয়ে টিম গঠন করে কাজ করতে হবে। দীর্ঘদিন পড়ে থাকা কনটেইনারগুলো যদি ব্যবহারের যোগ্য হয়, সেগুলো সংশ্লিষ্ট খাতে নামমাত্র মূল্য দিয়ে সরবরাহ করতে হবে, নতুবা ধ্বংস করতে হবে।”
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের সহকারী কমিশনার আব্দুস সাত্তার জানিয়েছেন, “আমরা ধ্বংসযোগ্য কনটেইনারের বিষয় নিয়ে কাজ করছি। তবে এসব কনটেইনার ধ্বংসের সক্ষমতা আমাদের নেই। এর আগে লাফার্জ হোলসিম কিছু কনটেইনার ধ্বংস করেছে, কিন্তু এখন তারা আর করবে না। কাস্টম হাউস থেকে বন্দরের কাছে হস্তান্তর করা কনটেইনারও বন্দরের পক্ষ থেকে ধ্বংস করা সম্ভব নয়।” তিনি আরও বলেন, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী লুৎফে সিদ্দিকীর সঙ্গে কাস্টম হাউস, বন্দরসহ বিষয়টি নিয়ে বৈঠক হয়েছে। বিপজ্জনক কনটেইনার ধ্বংসের জন্য সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের নির্দেশনা চাওয়া হচ্ছে।

