দীর্ঘদিন ধরে বৈশ্বিক বাণিজ্য ও শিল্প লেনদেনে মার্কিন ডলার ছিল একচ্ছত্র প্রভাবশালী। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বজুড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের বড় একটি অংশ ধীরে ধীরে ডলার থেকে সরিয়ে সোনায় স্থানান্তর করছে।
মার্কিন আর্থিক প্রতিষ্ঠান জেপিমরগ্যানের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এই পরিবর্তন এখন এক বৈশ্বিক প্রবণতায় পরিণত হচ্ছে।
জেপিমরগ্যান জানায়, বহু দেশ এখন রিজার্ভে রাখা ডলারের পরিবর্তে সোনা জমা করছে, যা নিরাপদ সম্পদ হিসেবে ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দামও ঊর্ধ্বমুখী।
২০২৪ সালের শেষে বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর কাছে মোট ৩৬,২০০ টন (প্রায় ৩ কোটি ৬২ লাখ কিলোগ্রাম) সোনা রিজার্ভ হিসেবে ছিল—যা তাদের মোট সম্পদের প্রায় ২০ শতাংশ। এক বছর আগেও এই হার ছিল ১৫ শতাংশ। অর্থাৎ মাত্র এক বছরের ব্যবধানে সোনার রিজার্ভ বেড়েছে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ।
গত বছর সবচেয়ে বেশি সোনা কিনেছে চীন, তুরস্ক, ভারত, ইরাক ও আজারবাইজান—প্রতিটি দেশই এক বছরে গড়ে ২০ টন করে সোনা যুক্ত করেছে তাদের রিজার্ভে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার কমে যাওয়া, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা এই প্রবণতাকে আরও ত্বরান্বিত করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সোনার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এর স্থিতিশীলতা। মুদ্রা বা সরকারি বন্ডের মতো সম্পদের মান রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বা বাজার ধাক্কায় হঠাৎ কমে যেতে পারে, কিন্তু সোনার দাম তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল থাকে।
ডলার দুর্বল হয়ে পড়লে সোনার চাহিদা সাধারণত বেড়ে যায়, কারণ বিনিয়োগকারীরা তখন নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে সোনার দিকেই ঝুঁকে পড়েন।
জেপিমরগ্যানের পূর্বাভাস অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের অনিশ্চিত বাণিজ্যনীতি ও ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক চাপের কারণে ২০২৫ সালে বিশ্বজুড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো আরও ৯০০ টন সোনা কিনতে পারে।
ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের তথ্যমতে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় সোনার ভান্ডার রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটির রিজার্ভে রয়েছে প্রায় ৮,১৩৩ টন সোনা—যা তাদের মোট বৈদেশিক সম্পদের ৭৮ শতাংশ।
আইএমএফের তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স এবং ইতালি—এই চারটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে মোট ১৬,৪০০ টন সোনা থাকবে। তাদের রিজার্ভের ৭০ শতাংশেরও বেশি সোনা দিয়ে গঠিত, যা বৈশ্বিক সোনার রিজার্ভের সবচেয়ে বড় অংশ।
অর্থনীতিবিদদের মতে, সোনার এই উত্থান কেবল একটি বিনিয়োগ প্রবণতা নয়—এটি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ভারসাম্যের পরিবর্তনের ইঙ্গিতও বহন করছে। যেখানে ডলারের প্রভাব কিছুটা কমে গিয়ে সোনার ওপর নির্ভরতা আবারও বাড়ছে।

