সরকার ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতকে আরও গতিশীল ও সক্ষম করতে বড় ধরনের নীতিমালার পরিবর্তন এনেছে। এর অংশ হিসেবে রপ্তানি আদেশ থেকে প্রাপ্ত আয়ের ১০ শতাংশ ব্যাংকে জমা রাখার বাধ্যবাধকতা এসএমই উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে আর থাকবে না।
একই সঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নমুনা ছাড়ের প্রক্রিয়া দ্রুত ও সহজ করতে পদক্ষেপ নিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও ডিজিটাল মানিব্যাগের মাধ্যমে অর্থ গ্রহণে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের মতো সুবিধা দিতে নীতিমালা সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। অনলাইন বিক্রির অর্থ বিলম্ব ছাড়া উদ্যোক্তাদের ব্যাংকে জমা দিতে এসএসএল কমার্স ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এসব পরিবর্তনের মূল লক্ষ্য—অর্থপ্রবাহকে আরও স্বচ্ছন্দ করা এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়িক গতি বাড়ানো।
এসএমই খাতকে জাতীয় অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তিতে রূপান্তরের রূপরেখা নির্ধারণে উচ্চপর্যায়ের বিনিয়োগ সমন্বয় কমিটি কয়েক মাসে চারটি বৈঠক করেছে। বৈঠকে অংশ নিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানসহ সরকারি ও বেসরকারি খাতের প্রতিনিধি। আলোচনায় উদ্যোক্তাদের সরাসরি অংশগ্রহণ বাড়ানো, নীতি প্রণয়নে মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া এবং বাস্তব সমস্যার সমাধানে সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
গতকাল শনিবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়েছে, এসএমই খাতের বৈঠকের ধারাবাহিকতা শুরু হয় ২৮ আগস্ট। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে আয়োজিত প্রথম সভায় আলোচনায় উঠে আসে উদ্যোক্তাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ—অর্থ প্রদানে বিলম্ব, কাস্টমসের জটিলতা, লাইসেন্সপ্রাপ্তির বাধা ও ঋণ সীমাবদ্ধতা।
এরপর ২১ সেপ্টেম্বর এসএমই ফাউন্ডেশনের সভাকক্ষে দুই ঘণ্টা ব্যাপী মুক্ত আলোচনায় উদ্যোক্তারা তাঁদের অভিজ্ঞতা, সমস্যা ও প্রস্তাব তুলে ধরেন। সুপারিশগুলো পরবর্তী সময়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থার কাছে পাঠানো হয়। ৮ অক্টোবর দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত উদ্যোক্তাদের সঙ্গে অনলাইন বৈঠকে মাঠপর্যায়ের মতামত ও বাস্তব চিত্র উপস্থাপন করা হয়। পরদিন, ৯ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংকে আয়োজিত বৈঠকে এসব প্রস্তাব পর্যালোচনা করে চারটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যা এখন বাস্তবায়নের পথে।
বাস্তবায়নাধীন সিদ্ধান্তের মধ্যে অন্যতম উদ্যোক্তাবান্ধব নতুন আর্থিক পণ্য তৈরি। বাংলাদেশ ব্যাংক ও এসএমই ফাউন্ডেশন যৌথভাবে কর্মশালার আয়োজন করেছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পমাস্টার সার্কুলারের কার্যকারিতা যাচাই করা হচ্ছে। পাশাপাশি ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বাণিজ্য লাইসেন্স ছাড়াই ঋণ প্রদানের সম্ভাব্যতা পরীক্ষা চলছে। ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন কর্মসূচিতে সুদের হার পুনর্বিবেচনার বিষয়ও আলোচনায় রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছে। ব্যাংক গ্যারান্টি ছাড়া আগাম অর্থ প্রদানের সীমা ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার মার্কিন ডলার বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা সংরক্ষণ (ইআরকিউ) হিসাব থেকে পরিশোধের সীমা ২৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার ডলার করা হয়েছে। স্থানীয় বিমা কোম্পানির কভারেজসহ উন্মুক্ত হিসাবের মাধ্যমে রপ্তানি লেনদেনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এইচএস কোড-সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে এনবিআর নতুন নিয়ম চালু করেছে। এখন থেকে আট অঙ্কের কোডের প্রথম চার অঙ্ক মিলে গেলেই শুল্ক কর্তৃপক্ষ মূল্যায়ন সম্পন্ন করবে। এতে পণ্যছাড় প্রক্রিয়া দ্রুত ও সহজ হবে।
এসএমই ফাউন্ডেশন উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন সুযোগও তৈরি করছে। প্রস্তাব করা হয়েছে, প্রতিটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নামে বছরে ন্যূনতম তিন হাজার মার্কিন ডলারের পৃথক বৈদেশিক মুদ্রা কোটা থাকবে। বিশেষ বৈদেশিক মুদ্রা কার্ড চালুর পরিকল্পনাও রয়েছে। বিদেশি ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশের ক্ষুদ্রশিল্পকে দৃশ্যমান করতে বৈদেশিক বাণিজ্য ইনস্টিটিউট আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী বলেন, “এই সংস্কারের লক্ষ্য অর্থনীতিতে গতি ফিরিয়ে আনা। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা আমাদের অর্থনীতির আসল মেরুদণ্ড। তাদের জন্য ব্যবসার প্রতিটি ধাপ সহজ করতে হবে। অর্থায়ন, অর্থ প্রদান কিংবা সরবরাহ—সব জায়গায় সরকারকে সহায়ক ভূমিকা নিতে হবে, বাধা নয়।”

