আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলার বিনিময় হার নির্ধারণের প্রক্রিয়া ও দুর্বল ব্যাংকগুলোকে জামানত ছাড়া বিপুল ঋণ দেওয়ার বিষয় নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংস্থার মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনও পুরোপুরি বাজারভিত্তিক ডলারের দর নির্ধারণ করছে না এবং রেফারেন্স রেটের মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণ করছে। পাশাপাশি আইএমএফ প্রশ্ন তুলেছে, জামানত ছাড়া ৫২ হাজার কোটি টাকার ঋণ কতটা যৌক্তিক ও টেকসই।
গতকাল রোববার ঢাকায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে আইএমএফ প্রতিনিধিদলের বৈঠকে এসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বৈঠকে নেতৃত্ব দেন সংস্থার গবেষণা বিভাগের ডেভেলপমেন্ট ম্যাক্রো ইকোনমিকসের প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিও। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন ডেপুটি গভর্নর নুরুন নাহার, ড. হাবিবুর রহমান, জাকির হোসেন চৌধুরী, ড. কবির আহমেদ ও গবেষণা বিভাগের নির্বাহী পরিচালক ড. এজাজুল ইসলাম।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, আইএমএফ জানতে চেয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক কীভাবে ডলার বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। জবাবে গভর্নর মনসুর বলেন, রেফারেন্স রেটের ভিত্তিতে বাজারমূল্য নির্ধারণ করা হচ্ছে। তবে আইএমএফ সতর্ক করেছে, রেফারেন্স রেট প্রকৃত বাজারভিত্তিক নয়। বাজারমূল্য বাস্তবমুখী করতে হলে তা পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে।
রেফারেন্স রেট সাধারণত কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত একটি মানদণ্ড, যা বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে ব্যবহার হয়। আইএমএফ মনে করে, এটি ডলারের প্রকৃত বাজারমূল্য প্রতিফলিত করে না এবং আমদানি-রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহে বিকৃতি তৈরি করে। বৈঠকে দুর্বল ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট ও জামানতহীন ঋণের বিষয়েও আলোচনা হয়। জানা যায়, গত এক বছরে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে কয়েকটি সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংককে, যা বেশির ভাগই শুধুমাত্র প্রতিশ্রুতিপত্রের মাধ্যমে নেওয়া হয়েছে। এসব ঋণ এখনও ফেরত পাওয়া যায়নি। আইএমএফ এই প্রথাকে ‘অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে উল্লেখ করে তা অবিলম্বে বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে।
আইএমএফ আরও জানতে চেয়েছে, কেন বাংলাদেশ ব্যাংক এসব ঋণে গ্যারান্টার হিসেবে ভূমিকা নিচ্ছে এবং এতে রাষ্ট্রীয় ঝুঁকি কতটা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো নির্দিষ্ট উত্তর দেয়নি। সংস্থাটি সন্তোষ প্রকাশ করেছে, বিগত সরকারের সময় গোপন রাখা খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র এবার প্রকাশিত হওয়ায়। তবে আইএমএফ মনে করে, সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ দ্রুত ১০ শতাংশের নিচে নামাতে হবে। এটি ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তির অন্যতম শর্ত।
গত জুন শেষে দেশে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬ লাখ ৬৭ হাজার কোটি টাকায়, যা এক বছরে প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা বেড়েছে। সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপির হার ৪০ শতাংশ ছাড়িয়েছে, আর বেসরকারি খাতে তা ১০ শতাংশের উপরে। আইএমএফ প্রতিনিধিদল রিজার্ভ থেকে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) ও অন্যান্য পুনঃঅর্থায়ন কর্মসূচি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। তারা জানতে চেয়েছে, এসব উদ্যোগ দেশের বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চয় ও আর্থিক স্থিতিশীলতার ওপর কী প্রভাব ফেলছে। বৈঠকে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সাম্প্রতিক সাফল্যকে আইএমএফ স্বাগত জানিয়েছে। তবে তারা সতর্ক করেছে, দীর্ঘমেয়াদী সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
সূত্র জানায়, আইএমএফ প্রতিনিধি রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের সর্বশেষ আর্থিক অবস্থা, তারল্য সংকট, প্রভিশন ঘাটতি, বৈদেশিক মুদ্রা সংকট ও জলবায়ু সহনশীল বিনিয়োগ কার্যক্রম সম্পর্কেও বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তির মাধ্যমে আইএমএফ কর্মসূচিতে বাংলাদেশ যুক্ত হয়। পরে ঋণের পরিমাণ ৫.৫ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। এ পর্যন্ত চার কিস্তিতে বাংলাদেশ পেয়েছে প্রায় ৩৬৫ কোটি ডলার।
বৈঠকের শেষে আইএমএফ স্পষ্টভাবে জানায়, ডলারের মূল্য পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করতে হবে এবং দুর্বল ব্যাংকগুলোকে জামানতহীন ঋণ দেওয়ার প্রথা বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা ও আন্তর্জাতিক আস্থা উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

