দেশে গ্যাসের ঘাটতি মেটাতে ব্যয়বহুল তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে পেট্রোবাংলা ৫৫ হাজার কোটি টাকার এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা করেছে। এর মধ্যে প্রায় ২৯ শতাংশ কার্গো স্পট মার্কেট থেকে কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির তুলনায় স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম সব সময় বেশি থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি আগে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে বেশি মনোযোগ দেওয়া হত, তবে কম খরচে আরও বেশি এলএনজি কেনা যেত। এতে স্পট মার্কেট থেকে আমদানিও কম হতো। পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে দেশে এলএনজি কার্গো আসবে ৭১টি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায়। স্পট মার্কেট থেকে মোট ৩৩টি কার্গো কেনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে প্রতি ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট (এমএমবিটিইউ) এলএনজির দাম ৯–১১ ডলারের মধ্যে, যেখানে স্পট মার্কেটে দাম প্রাক্কলিত ১৪ ডলার। তবে সর্বশেষ কেনা স্পট কার্গোর দাম পড়েছে ১১.৮৮ ডলার প্রতি এমএমবিটিইউ।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, এলএনজি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত ব্যয়বহুল জ্বালানি। ক্ষমতাচ্যুত বিগত সরকার সাশ্রয়ী মূল্যে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে বেশি মনোযোগ দিলে স্পট মার্কেটের ব্যয় এড়ানো যেত। এখন স্পট মার্কেট থেকে অনেক কার্গো কেনার লক্ষ্য রাখা হয়েছে। সেক্টরের বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেন, গত দুই দশকে স্থানীয় গ্যাস অনুসন্ধান ও বিনিয়োগ খুবই সীমিত হয়েছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে কূপ খনন ও জরিপে বরাদ্দ মাত্র ১ হাজার ১ কোটি টাকার কিছু বেশি। সীমিত এ অর্থ দিয়ে বিশাল অনুসন্ধান কার্যক্রম চালানো কঠিন। জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলেন, নতুন দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি কার্যকর হলে স্পট মার্কেট থেকে কার্গো আমদানি কমবে। ২০২৬ সালে স্পট থেকে মাত্র ১৭টি কার্গো কেনা হবে। এছাড়া দাম কম হলে স্পট মার্কেট থেকে কার্গো কিনা কমিয়ে আনার সুবিধা থাকবে।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে সব কার্গো নেওয়ায় কিছু অসুবিধা আছে। তাই ১০–২০ শতাংশ এলএনজি কার্গো স্পট মার্কেট থেকে কেনার সুযোগ রাখা উচিত। খারাপ আবহাওয়ায় বা সরবরাহে ত্রুটিতে স্পট মার্কেট সমাধান দেয়। এছাড়া দাম কমে গেলে সাশ্রয়ও সম্ভব।’ পেট্রোবাংলার ব্যয় বাড়ার এক বড় কারণ হলো ল্যান্ডবেজড বা স্থায়ী এলএনজি টার্মিনালের অভাব। বিগত সরকার ভাসমান টার্মিনালে বেশি মনোযোগ দেওয়ায় ল্যান্ডবেজড টার্মিনাল নির্মাণ হয়নি। ফলে সরবরাহে ঝুঁকি ও রিগ্যাসিফিকেশন চার্জসহ অন্যান্য ব্যয় বেড়েছে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরে সামিট ও এক্সিলারেটের টার্মিনাল থেকে এলএনজি রিগ্যাসিফিকেশনে খরচ ধরা হয়েছে ২ হাজার ২৫১ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ থেকে এই আট বছরে দুটি টার্মিনালের জন্য রিগ্যাসিফিকেশনে অন্তত ১৬ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শুরুতে ল্যান্ডবেজড টার্মিনাল তৈরি করলে এই ব্যয়ের ৭০ শতাংশই হতো।
পেট্রোবাংলার সাবেক এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, তিন বছর আগে কাতার ও ওমান থেকে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির প্রস্তাব পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন সরকার তা গ্রহণ করেনি। বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম কম থাকায় সাশ্রয়ী প্রস্তাব উপেক্ষা করা হয়েছিল।
রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালে ল্যান্ডবেজড টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে ১০০০ মিলিয়ন ঘনফুট সক্ষমতার টার্মিনাল নির্মাণের জন্য ইওআই আহ্বান করা হয়। তবে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি ও সরকারি মন্ত্রণালয়গুলোর তৎপরতায় প্রকল্পটি এগোয়নি।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার পুনরায় ল্যান্ডবেজড টার্মিনাল নির্মাণে উদ্যোগ নিয়েছে। এটি পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) মডেলে করা হবে। ইতোমধ্যেই ছয়টি কোম্পানি আগ্রহ দেখিয়েছে। সচিব বলেন, ‘প্রকল্পে অগ্রগতি সন্তোষজনক। শর্টলিস্ট করা হয়েছে এবং একজন প্রজেক্ট ডিরেক্টর নিয়োগ করা হয়েছে। আশা করি দ্রুত কাজ শুরু হবে।’
বৈশ্বিক তথ্য অনুযায়ী, স্থায়ী এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে ব্যয় ৫০–১০০ কোটি ডলার হতে পারে। বাংলাদেশের অনশোরে টার্মিনাল নির্মাণে প্রাক্কলন করা হয়েছে ১০০ কোটি ডলার। ভাসমান টার্মিনাল ৫০ কোটি ডলারের ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়। স্থানীয় গ্যাস উত্তোলন হ্রাস পাচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ না থাকায় এবং এলএনজি আমদানি বাড়ানোর ফলে সরবরাহে সংকট তৈরি হয়েছে। বর্তমানে ৩৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজির বিপরীতে সরবরাহ হচ্ছে ২৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুটের কিছু বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলেন, স্থানীয় উত্তোলন বাড়ানোই দীর্ঘমেয়াদি সমাধান।
পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে মোট ১১৫টি এলএনজি কার্গো কেনা হচ্ছে। এর মধ্যে কাতার এনার্জি থেকে ৪০ কার্গো ১৫ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা, ওমান থেকে ১৬ কার্গো ৫ হাজার ৮৩২ কোটি, স্বল্পমেয়াদি চুক্তিতে ১১ কার্গো ৫ হাজার ৯৩২ কোটি। নতুন দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে কাতার এনার্জি থেকে ৬ কার্গো ২ হাজার ৩৩০ কোটি, ওকিউ ট্রেডিং থেকে ২ কার্গো ৮২২ কোটি, মার্কিন এক্সিলারেট এনার্জি থেকে ৭ কার্গো ২ হাজার ৮২২ কোটি। স্পট মার্কেট থেকে ৩৩ কার্গো ১৮ হাজার ১৮৫ কোটি টাকায় কেনা হবে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরূল ইমাম বলেন, ‘স্থানীয় গ্যাস কমে যাওয়ায় আমদানি করে চাহিদা মেটানো স্থায়ী সমাধান নয়। এলএনজি আমদানির পেছনে বড় ঝুঁকি আছে। মূল সমাধান হলো স্থানীয় উত্তোলন বৃদ্ধি ও নতুন অনুসন্ধান-ড্রিলিং। বাংলাদেশে বিগত সময়ে সবচেয়ে কম কূপ খনন হয়েছে। এখনো পর্যাপ্ত হচ্ছে না।’ জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে ৮টি রিগ কাজ করছে। আরও ২টি রিগ আনা হচ্ছে। ৫০টি কূপ খননের পাশাপাশি ২০২৮ সালের মধ্যে নতুন ১০০টি কূপ খননের পরিকল্পনা রয়েছে।

