দফায় দফায় গ্যাসের দাম বাড়িয়েও চাহিদামতো সরবরাহ দিতে না পারায় দেশের শিল্প উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এর মধ্যে গ্যাসকূপ খননে অগ্রগতি না হওয়ায় সংকট আরও গভীর হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
গত কয়েক বছরে, বিশেষ করে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে দেশের অর্থনৈতিক সংকট ও বিনিয়োগ স্থবিরতার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে জ্বালানি সংকট। দেশীয় উৎসে গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন না বাড়িয়ে বিগত সরকার উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানির নীতি নেয়। সেই সিদ্ধান্তের ফল এখন ভোগ করছে দেশ। অন্তর্বর্তী সরকারের সময় সেই নীতির পরিবর্তনের কথা উঠলেও বাস্তব উদ্যোগে অগ্রগতি দেখা যায়নি। ফলে গ্যাস সংকটের বৃত্ত থেকে দেশ এখনো বেরোতে পারেনি।
চাহিদার তুলনায় ঘাটতি একশ কোটি ঘনফুটের বেশি: দেশে প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৩৮০ কোটি ঘনফুট। এর বিপরীতে সরবরাহ হচ্ছে মাত্র ২৭০ থেকে ২৮০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে দেশীয় উৎপাদন ১৭৭ কোটি ঘনফুট, আর আমদানি করা এলএনজি ১১০ কোটি ঘনফুটের মতো। ফলে দৈনিক ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১০০ থেকে ১১০ কোটি ঘনফুটে।
অর্থনীতিতে প্রাণ ফেরাতে ও বিনিয়োগে গতি আনতে হলে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো ছাড়া বিকল্প নেই। ২০১৭ সালে দেশীয় উৎস থেকে সর্বোচ্চ ২৭০ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত হয়েছিল। এরপর থেকেই শুরু হয় এলএনজি নির্ভরতা। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট, বৈশ্বিক দামের অনিশ্চয়তা ও অবকাঠামোগত দুর্বলতায় এখন পর্যাপ্ত এলএনজি আমদানি সম্ভব হচ্ছে না। জ্বালানিবিশেষজ্ঞদের মতে, নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান ও পুরোনো কূপ পুনঃখননের মধ্য দিয়েই টেকসই সমাধান সম্ভব। বিগত সরকার ২০২২ সালে চার বছরে ৫০টি কূপ খনন, সংস্কার ও অনুসন্ধানের উদ্যোগ নিলেও কাজ অগ্রগতি খুব ধীর।
অন্তর্বর্তী সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইন বাতিলের পর দরপত্র আহ্বান ও চুক্তিতে সময় বেড়েছে, তবে ব্যয় কিছুটা কমেছে। ডিসেম্বরের মধ্যে সব কূপ খননের লক্ষ্য থাকলেও এখন পর্যন্ত শেষ হয়েছে মাত্র ২০টি। এতে যেখানে দৈনিক ৬২ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদনের কথা ছিল, সেখানে পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ২১ কোটি ঘনফুট। এদিকে সরকার নতুন করে ১০০টি কূপ খননের আরেকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। কিন্তু দেশীয়ভাবে খননযন্ত্র বা রিগের ঘাটতি এখন বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাপেক্স, বিজিএফসিএলসহ দেশীয় অনুসন্ধান ও উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বাড়ানোর দাবি বহুদিনের, কিন্তু পূর্ববর্তী সরকারগুলো তাতে গুরুত্ব দেয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নীতিনির্ধারণে এখানেই বড় দুর্বলতা রয়েছে। দ্বীপজেলা ভোলায় প্রায় ১ হাজার ৪৩২ কোটি ঘনফুট গ্যাসের সম্ভাব্য মজুত আছে। কিন্তু পর্যাপ্ত অবকাঠামো না থাকায় উৎপাদন সীমিত। সেখানকার গ্যাস অন্য এলাকায় সরবরাহের পাইপলাইন স্থাপন করা হয়নি, আবার স্থানীয় শিল্পায়নও এগোয়নি। সমুদ্রের গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমও দীর্ঘদিন ধরে স্থবির।
জ্বালানি নীতিতে এখন জাতীয় সক্ষমতা ও দেশীয় উৎসের ওপর গুরুত্ব বাড়ানো সময়ের দাবি। তাৎক্ষণিক সমাধানের টোটকা নয়, প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। স্থল ও সমুদ্রে অনুসন্ধান, কূপ খনন, উন্নয়ন এবং সরবরাহের অবকাঠামো গড়ে তুলতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

